ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

পবিত্র ঈদুল আজহার বিশেষ নিবন্ধ

কোরবানির তাৎপর্য ও এর বিচ্যুতির আখ্যান

মাওলানা হোসেন আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১০
কোরবানির তাৎপর্য ও এর বিচ্যুতির আখ্যান

প্রতি বছরের মতো এবারও সেই দিনটি আমাদের কাছে সমাগত। মোবারক ঈদুল আজহা।

কোরবানির ঈদ। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় ঈদ এবং কোরবানি। এর সঙ্গে যুক্ত আছে হজ। হজের প্রধান কার্যক্রম পালিত হয় মক্কা মোকাররমায় জিলহজ মাসের ৯ তারিখে। এ হজ এবং কোরবানি প্রতি বছর আসে, যুগ যুগ ধরে আসছে, এর ইতিহাস অনেক পুরনো। হজ, কোরবানি এবং কোরবানির ঈদ মুসলমানদের উৎসব ও ইবাদত। তবে এসবের সূচনা উম্মতে মুহাম্মদির অনেক আগে। অনেক সুদূরপ্রসারী উত্তরাধিকার ও শিা বহন করে এই মহতি দিনটি আমাদের কাছে আসে।

মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সেমিটিক জাতি-গোষ্ঠীর এক মহান পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষা, আদর্শ ও উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে হজ এবং কোরবানি পালিত হয় মুসলিম সমাজে। তবে ইসলামের হজ, কোরবানি ও ঈদ ইসলামী শরিয়তে পরিশীলিত এবং চিরায়ত ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অনুশীলন। অন্যান্য কিতাবি ধর্ম এর উত্তরাধিকার ধারণ করে না। হজের সূচনা হজরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে। কোরবানি মানবজাতির আরো আদি অবস্থা থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কোরআন মজিদের বর্ণনা থেকে আভাস পাওয়া যায়, জগতের প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) ও তাঁর পুত্ররা পশু কোরবানি করে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন।

মানবজাতির নানা গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে চরম বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে বার বার। আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসুলরা এসে তাঁদের সুপথে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে মানবজাতির আদি যুগে অসভ্যতা, বর্বরতা ও বিভ্রান্তির ইতিহাসই দীর্ঘ ও বিস্তৃত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আদি ঐতিহাসিক যুগের মানবগোষ্ঠী ধর্মের নামেও নানা বর্বরতার পর্ব পাড়ি দিয়েই এ পর্যন্ত এসেছে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) যে যুগে জন্মেছিলেন সেই যুগে তাঁর গোত্রের মতাশালী মানুষরাও দুর্বল গোত্রের মানুষদের আরিক অর্থেই হত্যা বা কোরবানি দিয়ে ঈশ্বরের করুণা লাভের চেষ্টা করত। অথবা ঈশ্বরের করুণার নামে নিজেদের পরাক্রম প্রকাশ করত। হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির প্রধান তাৎপর্য হলো তিনি পশু কোরবানির মাধ্যমে চিরকালের জন্য মানুষ কোরবানির মতো অমানবিক বর্বরতার প্রথা উচ্ছেদ করেছিলেন।

 হজরত ইব্রাহিম কর্তৃক নিজ পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার ব্যাপারে বর্তমানে যেসব গল্প প্রচলিত আছে সেগুলোতে অনেক মিথ বা কল্পকাহিনী ও বিভ্রান্তিকর ধারণাও ঢুকে গেছে। এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য ও মহত্ত্ব ঢাকা পড়ে গেছে এবং মহাপুরুষ হজরত     ইব্রাহিম (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে ইসমাঈল (আ.) এর গলায় আরিক অর্থেই ছুরি চালানো এবং স্বপ্নকে আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে।
 
কোরআন  মজিদে সুরা সাফফাতে এ ব্যাপারে কিছু কথা এসেছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে স্বপ্নের কথা। নবী-রাসুলগণ আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেতেন ‘ওহি’র মাধ্যমে, স্বপ্নের মাধ্যমে নয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেছেন, ‘হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে জবাই করছি। ’ এখানে আল্লাহ তায়ালা নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে কায়িক অর্থেই পুত্র জবাই করার নির্দেশ দিয়েছেন এমন বোঝার কোনো কারণ নেই। প্রথমত সেটা স্বপ্ন, যার মাধ্যমে আল্লাহ নবীদের নির্দেশ দেন না। এমনকি কোনো মানুষকেই দেন না। মানুষ স্বপ্নে কত কিছুই দেখে। স্বপ্নে দেখার নির্দেশকে আল্লাহর নির্দেশ বলে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ নয়। দ্বিতীয়ত আল্লাহ তায়ালা মানুষ জবাই করার নির্দেশ দেন না, এটা সত্য ও ন্যায়ের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আল্লাহ তায়ালার সিফতি রূপ হচ্ছে সত্য ও ন্যায়।

অপরদিকে পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালানো হয়েছিল, গলা কাটছিল না, আল্লাহর ফেরেশতারা আকাশ থেকে দুম্বা এনে ধারালো ছুরির নিচে ধরলেন ইত্যাদি আল্লাহর প্রকৃতি বিরুদ্ধ এবং অন্ধকার যুগের তৈরি  করা মিথ। আসলে প্রিয় পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে নির্জন মরুদ্যানে ফেলে দিতে বাধ্য হয়ে ইব্রাহিম (আ.) যে কাজটি করেছিলেন সেটিই ছিল কোরবানি। পুত্র ইসমাঈল (আ.) এতে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন এবং পিতার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। এ ঘটনাই সুরা সাফফাতে বর্ণনা করা হয়েছে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম হয়েছিল প্রাচীন ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমিতে। খ্রিস্ট-জন্মের অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে দজলা-ফোরাত তীরবর্তী প্রাচীন যুগের জাতি অধ্যুষিত ব্যাবিলনীয় সেমিটিক শাসকগোষ্ঠীতে তাঁর জন্ম বলে ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন। সেসব জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা নানা দেব-দেবীর পূজা করত। সেমিটিকরাও একেশ্বরের বার্তা ভুলে গিয়ে দেব-দেবীর পূজায় লিপ্ত হয়েছিল। দেব-দেবীর আনুগত্যের নামে যোদ্ধা শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতাপ প্রদর্শনের জন্য পশু কোরবানির পাশাপাশি মানুষও কোরবানি করত। নবী হজরত ইব্রাহিম এদের এই অমানবিক বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি দেব-দেবীর পূজা থেকে মানুষকে বিরত করে এক সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাচীন ব্যাবিলনের বর্বর যোদ্ধা সমাজ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সে কথায় কান দেয়নি। তাঁর পিতৃপুরুষরা তাঁর ডাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আসেনি। উপরন্তু তাঁর ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালায়। বর্বর যোদ্ধা গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করে ধ্বংসের মুখোমুখি হলেও ইব্রাহিম (আ.)-কে তারা দেশত্যাগে বাধ্য করে।

পারিবারিক আত্মকলহের পরিণতিতে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি হাজেরাসহ পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের বাইরে সুদূর মক্কার জনমানবহীন মরুদ্যানে নির্বাসন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর এক বিশাল কোরবানি। কিন্তু কোনো কিছুর মাধ্যমেই তিনি তাঁর স্বজাতিকে এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ন্যায় ও সত্যকে স্বীকার এবং  মানুষকে পদানত রাখার জন্য মানুষ কোরবানির মতো অমানবিক বর্বরতা থেকে সুপথে আনতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনি ব্যাবিলন সাম্রাজ্য ত্যাগ করে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী কেনান, বর্তমান ফিলিস্তিন অঞ্চলে হিজরত করেন। মক্কায় তিনি প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার কথা বলে পরীা করে আল্লাহর প্রতি পুত্রের আনুগত্যের অভূতপূর্ব নজির দেখে পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন এবং বিশ্বজগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে মানুষ কোরবানির প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন।

কোরবানি আসলে আত্মত্যাগের মাধ্যমে জীবনকে পরিশীলিত করার নাম-- কোরবানি আসলে আত্মনিবেদন; জবাই করা পশুর রক্ত-মাংস এর দৃশ্যমান অবদান।

কোরবানির সেই দিন আজও নিয়মিত আমাদের সামনে আসে। আমাদের যাদের বড় আকারের মোটাতাজা পশু কেনার মতা আছে তারা পশু কোরবানি করি। কিন্তু সেই কোরবানিতে কতটা আছে ত্যাগের উপলব্ধি আর মানবতাকে মহিমান্বিত করার সেই তাৎপর্যবোধ? সেই ত্যাগ, সেই সাধনা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা বড় বড় পশু জবাই করে নিজেদের অর্থবিত্তের প্রভাব প্রতিপত্তি জাহির করি। কোরবানির মাংস দিয়ে ফ্রিজ ভর্তি করি; দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভূরিভোজন করি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কোরবানির পশুর রক্ত-মাংস তাঁর কাছে পৌঁছায় না, তিনি দেখতে চান মানুষের মন। আমরা জানি না, আমাদের মনের ভেতর কী দেখেন বিশ্বজাহানের পালনকর্তা।

কোরবানির জন্য অনেক দাম দিয়ে বাজারের সেরা পশু কেনা এবং একাধিক পশু কোরবানি করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই নাজায়েজ কিছু না। তবে আমাদের বিবেককে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন সেরা পশুটি আমরা কিনছি? মানুষকে দেখানোর জন্য নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যদি হয় তবে আরো অনেক প্রশ্ন আছে। চৌদ্দ কোটি মানুষের এই দেশে কজনের সামর্থ্য আছে মোটাতাজা ষাঁড় কেনার বা তৃপ্তি করে একবেলা ষাঁড়ের মাংস আহার করার। কেন নেই এর প্রোপটও আমাদের চিন্তা করতে দেখতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে আমাদের অবশ্যই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
 
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্পদ ব্যয় করতে বলেছেন, সঠিক পথে সম্পদ ব্যয়কারীদের তিনি পছন্দ করেন। কোরবানি অবশ্যই উত্তম ব্যয়। সম্পদ ব্যয়ের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি মানবকল্যাণমুখী, বিত্তের বৈভব প্রদর্শনমুখী নয়। হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে বসরার শাসনকর্তা সেখানে ইমারত বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খবর পেয়ে খলিফা হজরত ওমর (রা.) সেই গভর্নরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এবং নির্মাণাধীন ইমারত ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইসলামে ইমারত বানানো নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যে জনগণের অর্থনৈতিক সামর্থ্য তেমন ছিল না। জনগণকে ছেঁড়া তাঁবুর নিচে ফেলে রেখে আমিরুল মোমেনিন প্রদেশের শাসনকর্তাকে ইমারত বানানোর অনুমতি দেননি। এটাই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, চিরকালের দিকনির্দেশনা। এখন আমাদের এক শ্রেণীর লোকের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেড়েছে। আমরা নিজেদের ভোগের জন্য আলিশান ইমারত নির্মাণ করি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির নামে মোটা-তাজা গরু কোরবানি করি। কিন্তু আমরা যদি ইসলামের মানবকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভুলে যাই তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দরজায় পৌঁছানো কঠিন হবে তো নিশ্চয়ই।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৩৩০, নভেম্বর ১৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।