ঢাকা: যতোটা গর্জাচ্ছে ততোটা শক্তিশালী নয় জামায়াত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মূর্তিমান বিভীষিকা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ধর্মাশ্রয়ী এ দলটি মূলত নজিরবিহীন সহিংসতা ছড়িয়েই নিজেদের টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
গত বৃহস্পতিবার যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর থেকে সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে জমায়াত-শিবিরের সহিংসতা, নাশকতার স্থান ও কৌশল, ফতোয়াবাজি ও অপপ্রচারের ধরণ এবং জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব বিশ্লেষণ করলেই তাদের শক্তি ও সামর্থের মোটামুটি চিত্র পাওয়া যায়। পাশাপাশি ফুটে ওঠে নাশকতা মোকাবেলায় আগাম গোয়েন্দা তৎপরতা আর প্রশাসনের নানামুখী ব্যর্থতার চিত্রও।
গত পাঁচ দিনের সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যপক সহিংসতা ঘটেছে মাত্র গোটা সাতেক জেলায়। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ১৩ জন নিহত হয়েছে বগুড়ায়। সাতক্ষীরায় নিহত হয়েছে দশ জন। এছাড়া গাইবান্ধায় সাত, জয়পুরহাট ও রংপুরে ছয় জন করে এবং চট্টগ্রাম ও ঠাকুরগাঁওয়ে পাঁচ জন করে নিহত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই সাত জেলায় নিহত হয়েছে ৫২ জন।
এছাড়া নোয়াখালীতে চার এবং মৌলভীবাজার, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীতে তিন জন করে নিহত হয়েছে। দুই জন করে নিহত হয়েছে দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঢাকা ও কক্সবাজারে। এক জন করে নিহত হয়েছে নীলফামারী, নাটোর ও গাজীপুরে।
এগুলোর মধ্যে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় ২১ জন ও রাজশাহী বিভাগের ছয় জেলায় ২৭ জন নিহত হয়েছে। এ দুই বিভাগের ১১ জেলা মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৪৮।
খুলনা বিভাগের দুই জেলায় ১১ ও চট্টগ্রাম বিভাগের তিন জেলায় ১১ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিভাগের দু’টি জেলায় ও সিলেট বিভাগের এক জেলায় তিন জন করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের চলমান নাশকতার সিংহভাগই ঘটছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। দেশের অন্যান্য তথা অধিকাংশ স্থানেই জামায়াতি দাপট দেখা যায় নি। তাই মাত্র দশ থেকে ১২টি জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই মানবতাবিরোধী জামায়াতের সহিংসতা ঠেকানো যেতো বলে প্রত্যাশা করাটা বোধ হয় অতিরঞ্জিত হবে না।
তাহলে কেন তা সম্ভব হলো না? স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে কি করে এতোটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেলো ঘাতক-দালালরা? বাংলাদেশের স্বাধীনতার আইকন হয়ে ওঠা ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আর একবার’ স্লোগান কেন ধ্বণিত হলো স্বাধীনতার শত্রু শিবিরে?
কি করে ভাঙা পড়লো প্রাণের শহীদ মিনার? শহীদ মিনারে শহীদ স্মরণে পরম মমতায় বিছিয়ে দেওয়া ফুল পিষে ফেলার বা জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ধৃষ্টতা কোথায় পেলো তারা? কি করে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদের গায়ে দেখতে পাওয়ার গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে সক্ষম হলো ধর্ম ব্যবসায়ীরা? যাকে পছন্দ করে না নানা অপপ্রচার আর প্রতিবন্ধকতায় তাকে হেনস্থা করার লাগামহীন সুযোগ কেন পেতেই থাকলো তারা?
আর এমন পরিস্থিতিতে কি করলো গোয়েন্দারা? কেন এমন সহিংসতার আভাস আগেই পেলো না তারা? আর যদি পেয়েই থাকে তাহলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলো না কেন? যুদ্ধাপরাধীরা কি এতোটাই শক্তিশালী!
ব্যাপক সহিংসতা সত্ত্বেও গত পাঁচ দিনের সংবাদ বিশ্লেষণ কিন্তু যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের শক্তিমত্তা নয়, দিন দিন শক্তি হারানোর দৃশ্যই প্রকট করে তুলেছে। কেননা ধর্মীয় অনুভূতি পুঁজি করে চালানো অপপ্রচারে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেই মূলত ফায়দা লুটছে তারা। তাদের ধর্মান্ধতার উন্মাদনায় কোমলমতি মানুষ যেমন মরছে, তেমনি পুড়ছে সংখ্যালঘুদের জনপদ, উপাসনালয়। কে মুসলিম আর কে মুনাফেক তা নির্ধারণের স্বঘোষিত ঠিকাদারও যেন হয়ে উঠেছে ধর্মাশ্রয়ী জামায়াত।
কিন্তু সারাদেশে প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ যে জামায়াত-শিবির রাখে না তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে আগেই। এবার জনপ্রিয়তার কষ্টিপাথরে জামায়াতকে যাচাই করা যাক।
![train train](../../../images/PhotoGallery/2013March/train0120130304065843.jpg)
সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে ৩৯ আসনে অংশ নিয়ে মাত্র দু’টি আসনে জয়ী হয় জামায়াত। সব আসন মিলিয়ে সর্বমোট আট কোটি দশ লক্ষ ৮৭ হাজার ৩ ভোটের মধ্যে তারা পায় মাত্র ৩২ লক্ষ ৮৯ হাজার ৯৬৭ হাজার ভোট। যা মোট ভোটের ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ মাত্র। চলতি সংসদে প্রতিনিধিত্বের হিসেবে ৩টি আসন নিয়ে তাদের ওপরে আছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আর জামায়াতের সমানসংখ্যক ২টি আসন আছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির।
সর্বশেষ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ ও কক্সবাজার ২ আসনে জয়ী হয় জামায়াত। এর বাইরে ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর ১ ও ৬, নীলফামারী ২ ও ৩, রংপুর ১ ও ২, গাইবান্ধা ১, ৩ ও ৪, সিরাজগঞ্জ ৪, ঝিনাইদহ ৩, সাতক্ষীরা ২, ৩ ও ৪ আসনে তারা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে। সব মিলিয়ে আট জেলায় এ সংখ্যা মাত্র ১৫।
মূলত এসব আসনেই গত ৪/৫দিন ধরে ব্যাপক সহিংসতা ছড়ানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে জামায়াত। তবে জয়পুরহাট, রাজশাহী, বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঢাকা, গাজীপুর, মৌলভীবাজার ও নোয়াখালীর কোন আসনেই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে ব্যর্থ জামায়াত সহিংসতার জন্ম দেয় প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ওপর ভর করে। গত শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দেওয়া বিএনপির ব্যাপক শো ডাউনই বগুড়ায় জামায়াতকে বেপরোয়া হয়ে ওঠার শক্তি জুগিয়েছে।
তাই এ পর্যন্ত যেসব স্থানে পুলিশ-জনতার ওপর জামায়াত চড়াও হয়েছে সেসব এলাকাকে কড়া প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা জরুরি। একই সঙ্গে যেসব স্থানে এখনো সংঘর্ষ হয়নি কিন্তু গত নির্বাচনে জামায়াতের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো সেসব স্থানকেও নজরে আনা দরকার।
এগুলোর মধ্যে গত নির্বাচনে জামায়াতের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় লালমনিরহাট ১, পাবনা ৫, চুয়াডাঙ্গা ২, যশোর ১ ও ২, বাগেরহাট ৩ ও ৪, খুলনা ৫ ও ৬, পিরোজপুর ১, শেরপুর ১ ও সিলেট ৫ আসনকে সম্ভাব্য সংঘর্ষ আর সহিংসতার স্থান হিসেবে ধরে রাখা ভালো। তাহলে মোকাবিলা যেমন সুবিধা, তেমনি হতাহতের ঘটনাও হয়তো অনেক কম হবে।
এর বাইরে মানিকগঞ্জসহ আরো কিছু জেলায় অন্য দলের ওপর ভর করে সহিংসতা ছড়ালেও সবাই এখন জামায়াতকে এড়িয়ে চলার নীতি নিয়েছে। তাই স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে এতো ভয় পাওয়া কিছু নেই। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক জারিজুরি ফাঁস হচ্ছে তাদের।
শাহবাগে মদ্যপদের অশ্লীল নৃত্যের যে কথিত ছবি ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছিলো পরে দেখা গেছে তা থার্টি ফাস্ট নাইটের আলোকচিত্র, দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া কপিও মিলেছে এর। ব্লগার রাজিবের মৃত্যুর পরও তার ব্লগে পোস্ট দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
শিবিরের আইটি স্পেশালিস্টদের দিনও তাই শেষ হয়ে আসছে। ভাটা পড়ছে চাঁদের গায়ে সাঈদীকে দেখতে পাওয়ার আজগুবি গুজবেও। ফটোশপের খেলায় চাঁদের বদলে এখন কমোড, পশুপাখির পশ্চাদদেশ, পর্নো তারকার খোলা বুকেও সাঈদীকে সেঁটে দিচ্ছে ডিজিটাল প্রজন্ম।
এমনকি দেরিতে হলেও জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন আলেম-ওলামা-মাশায়েখরা।
সোমবারের হরতালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বের করা জামায়াত-শিবিরের মিছিলে খুব বেশি লোক দেখা যায়নি। দু’একটি স্থান ছাড়া আর প্রায় সব স্থানেই লেজ তুলে পালিয়েছে মানবতার শত্রুরা। ঘটছে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাও।
তাই জামায়াতের মতো বিষধর কাল কেউটের বিষহীন ঢোঁড়া সাপে পরিণত হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপারই বটে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১৩
জেডএম/