চট্টগ্রাম: ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণার প্রতি যে দরদ, ঠিক একই দরদ ছিল অসহায় মানুষের প্রতি। মাতৃভূমির প্রতিও অসীম ভালবাসা ছিল তাঁর।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের প্রস্থানে শোকাহত চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনরা বাংলানিউজের কাছে এভাবেই তাদের শোকগাঁথা তুলে ধরেছেন।
নগরীর সার্সন রোডের বাসভবনে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মরদেহ দেখতে এসে তারা বাংলানিউজের কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ মুঠোফোনে বাংলানিউজকে বলেন,‘অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম শিক্ষা ও গবেষণা চর্চায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পথিকৃৎ। দেশের প্রতি মমত্ববোধের কারণে তিনি বিদেশ থেকে চলে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। আমৃত্যু তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অটুট ছিল। তার গবেষণা ও স্মৃতি ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমের কাছে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম মানেই ‘কর্মপাগল’ ও ‘দেশপাগল’ সদা জাগ্রত এক মানুষ।
চুয়েট উপাচার্য বলেন,“শত ব্যস্ততার মাঝেও ‘স্যার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা মিস করতেন না। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতেন। ”
এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম স্যার আমাদের তিনটি কথা সবসময় বলতেন। তার তিনটি কথার সারমর্ম ছিল আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা-সংঘাতের সমাধান, গ্রামের উন্নয়নে নজর দেওয়া এবং নিজেদের অর্থায়নে ও মেধায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা। ’
চুয়েট উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের কাজ নিয়ে যুগ যুগ ধরে দেশ-বিদেশের গবেষকরা গবেষণা করবেন। পৃথিবীর মানুষ এর সুফল পাবেন। ’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবুল মনসুর চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন,‘স্যারের এভাবে চলে যাওয়ায় জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর গবেষণার জন্য এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ড. জামাল নজরুল ইসলাম।
ড. আবুল মনসুর বলেন, ‘জামাল নজরুল ইসলাম স্যার যেমন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি ছিলেন বৃহৎ হৃদয়ের মানুষ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার যেমন অবদান ছিল, তেমনি দেশের অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের উন্নয়ন নিয়ে তিনি সবসময় চিন্তা করতেন। ’
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন,‘ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম শুধু চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের সম্পদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্বের সম্পদ। তার অনুপস্থিতিতে আমরা উপলব্ধি করতে পারব, আমরা কী হারিয়েছি। যোগ্য মানুষটিকে জীবিত অবস্থায় আমরা প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি। ’
সাধারণ মানুষের প্রতি জামাল নজরুল ইসলামের দরদ তুলে ধরে তিনি বলেন,‘শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি প্রফেসর জামাল নজরুল। মানুষের সুখ-দুঃখ এবং সামাজিক সমস্যা ও অসংগতি দূর করতে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল। আঞ্চলিক ও জাতীয় যেকোন ধরণের সমস্যা সমাধানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। ’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মুন্সি নজরুল ইসলাম পিএইচডি গবেষণা করেছেন প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে।
তিনি বলেন, ‘স্যার সবসময় রিকশা চালক থেকে শুরু সমাজের অসহায় মানুষদের কথা ভাবতেন। তাদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা আছে, এটা স্যার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। ’
‘অনেক সময় দেখা যেত স্যার তার বেতনের একটি অংশ সবার অগোচরে সমাজের অবহেলিত মানুষদের দিয়ে দিতেন। ’-- যোগ করেন জামাল নজরুল ইসলামের এ ছাত্র।
পরিকল্পিত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সংগঠনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক স্থপতি সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘স্যার সবসময়ই বলতেন, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ জাতীয় সুদখোর প্রতিষ্ঠান আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের ৮০ভাগ অর্থ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতুর বিরোধিতা করেছেন তিনি। স্যারের বিশ্বাস দেশের যে মেধা ও সম্পদ আছে তা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। ’
স্থপতি সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের প্রতি জামাল নজরুলের নিখাদ ভালবাসা ছিল। তিনি একটি বৈষম্যহীন ও সমতাভিত্তিক সমাজরে স্বপ্ন দেখতেন। যেখানে সবার রুটি-রোজগারের নিশ্চয়তা থাকবে। দেশের এ সংকট মুহূর্তে স্যারকে বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩ ০৩ঘণ্টা, মার্চ ১৬,২০১৩
এসজি/আরডিজি