ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সাক্ষী সুরক্ষা আইন হচ্ছে না: নিরাপত্তা দেবে প্রশাসন

মেহেদী হাসান পিয়াস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩
সাক্ষী সুরক্ষা আইন হচ্ছে না: নিরাপত্তা দেবে প্রশাসন

ঢাকা: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সাক্ষীদের সার্বিক সুরক্ষা দিতে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ করা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছে না সরকার। তবে বিভিন্ন জেলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

   

ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আপাতত এ আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলানিউজকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের বিষয়টি এক রকম নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ ১৯৭৩ এর সঙ্গে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে একটি বিধি যুক্ত করা হয়েছে, তাই এ নিয়ে আপাততঃ ভাবছে না সরকার।    

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার দুই বছর পর গত বছরের ২৯ জুন ট্রাইব্যুনালের বিধিতে ৫৮নং বিধি যুক্ত করে এ অপরাধে মামলাগুলোর সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে সরকার। ৫৮ এর এ বিধি অনুযায়ী এ অপরাধের মামলায় সাক্ষীর নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইন উদ্দিনকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রতি জেলার জেলা প্রশাসককে এ কমিটির প্রধান করে পুলিশ সুপার, র্যাব প্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জেলা কমিটিও গঠন করা হয়।

সূত্র আরও জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেশে চার শতাধিক সাক্ষী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সাক্ষী রয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পিরোজপুর, ফরিদপুর, শেরপুর, পাবনা, রংপুর, জয়পুরহাট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায়। ওই ১২ জেলার জেলা ও পুলিশ প্রশাসন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাক্ষীদের নিরাপত্তায় কাজ করছে।

এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সর্বশেষ গত রোববার ২৪ মার্চ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার এবং পাবনার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে ফের চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ মোল্লা স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিটি পাঠানো হয়। |

এর আগে গত ১৪ মার্চ সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে উল্লেখিত ১২টি জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ওই সময় ঢাকা ও পাবনায় থাকা সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যও নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল। সর্বশেষ চিঠিতে সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, কয়েকদিন আগে পাবনা এলাকার ৩৭ জন ও ঢাকার ১০ জন সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার এক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানান। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই নতুন করে ডিএমপি কমিশনার ও পাবনার জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিচারাধীন মামলার সাক্ষী ও তার পরিবার এমনকি ভূক্তভোগীদেরও সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব উদ্যোগ যথাযথ নয় বলে দাবি করে সংশ্লিষ্টরা স্বতন্ত্র সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ কামনা করেছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মো. হান্নান খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘বিধি অনুযায়ী সাক্ষীদের সুরক্ষায় সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে তৎপরতা অপ্রতুল। অনেক সাক্ষী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ফলে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে তাদের আনাও কষ্টকর হয়ে পড়ছে। ’’

তিনি বলেন, ‘‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে, তা জানি না। তবে ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালের বিধিতে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি যুক্ত হলে আমরা আশা করেছিলাম, প্রশাসন এ বিষয়ে সর্বোচ্চ তৎপর হবে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনো আশাহত। ’’

বিভিন্ন জেলার সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করার জন্য তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে চিঠির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার অনুরোধ জানানো হয়েছে বলেও জানান হান্নান  খান।

তিনি জানান, বিভিন্ন সময়ে পাঠানো তদন্ত সংস্থার এসব চিঠিতে বলা হয়েছে, এ অপরাধের বিভিন্ন মামলার সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাদের লোভ, ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। এর ফলে অনেক সাক্ষীই সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন।

তদন্ত সংস্থার চিঠিতে আরো জানানো হয় যে, অধিকাংশ সাক্ষী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতে তারা আরো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই বিচারকাজে সহযোগিতার জন্য প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।

জেলা প্রশাসক সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির প্রধান হলেও অধিকাংশ জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন না বলেও অভিযোগ করেন তদন্ত সংস্থার প্রধান।

সম্প্রতি গোলাম আযমের মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজকে হত্যা করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদের বুলবুল বলেন, তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যই তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে রহস্যজনকভাবে মারা যান আরেক আসামি সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনু।

ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট ও বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ওপর প্রতিশোধ নিতেই হত্যা করা হয়েছে তার ছোট ভাইকে। একই কারণে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী জুনু প্রাণ দিয়েছেন বলেও দাবি তাদের।

মিরাজ ও জুনু নিহত হওয়ার আগে-পরের বেশ ক’টি হত্যাকাণ্ডকেও যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করে আন্দোলন ও মামলাগুলোর বিচার চলমান থাকার কারণে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, নারায়নগঞ্জের ত্বকী হত্যা, রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরে স্থপতি ও ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যা, গণজাগরণ মঞ্চের নিরাপত্তায় স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা রাজারবাগের ডিএমপি-২ এমআইসি আইটি শাখার কনস্টেবল বাদল মিয়া হত্যা।

তবে এসব ঘটনার পর পরই সরকারেরও টনক নড়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন মামলার প্রায় ৪০০ জন সাক্ষীর সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এসব উদ্যোগ যথাযথ নয় বলে দাবি করে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘সাঈদীর বিচার চলাকালে এ মামলার ২ জন সাক্ষী ভয়ে ভারতে চলে গেছেন। মামলার রায় হওয়ার পর সাক্ষীদের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছে। ’’

তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু এসব সাক্ষীরা রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সাক্ষী দিচ্ছেন, তাই রাষ্ট্রের উচিৎ, তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শুধু তাই নয়, তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করাটাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রয়োজনে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে এসব সাক্ষীদের বিশেষ নিরাপত্তায় রাখা প্রয়োজন। ’’

সাক্ষী সুরক্ষা আইনের বিষয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘আমরা ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরতেই এ বিষয়ে দাবি জানিয়েছি। তখন বলা হয়েছিল, এরকম একটি আইন প্রণয়নের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে। পরে যুক্তি দেখানো হলো, এ আইনটি করতে হলে সকল ক্রিমিনাল কেসের সাক্ষীদের এ আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি অনেক সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং বিশাল পরিকল্পনার। তাই ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের জন্য আলাদা করে এ আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। এখন কি পর্যায়ে আছে জানি না। ‘’

তবে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলো ‘ক্রিমিনাল কেস’ হওয়ার পরও যেহেতু বিশেষ আইনে পরিচালিত হচ্ছে, তাই এসব মামলার সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়েও বিশেষভাবে আইন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একাধিক মামলার কিছু সাক্ষীর সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।    

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩
এমএইচপি/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর- [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।