কক্সবাজার: সরকার ঘোষিত প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) অন্তর্ভুক্ত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে দ্বীপ খুড়ে অবৈধ পাথর উত্তোলনের ধারাবাহিকতায়।
সরেজমিনে সেন্টমার্টিন্স ঘুরে দেখা গেছে, সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মুখে দ্বীপের রাকবচ এর চারপাশের বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল ব্যবহার করে নির্মাণ করা হচ্ছে দালান।
শুধু দ্বীপের ভূমির ওপর থেকে পাথর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছে না প্রভাবশালী দাপুটে ইমারত নির্মাণকারীরা, তারা মাটির কয়েক ফুট নিচে থেকেও অবৈধভাবে উত্তোলন করছে প্রবাল পাথর। দ্বীপের বুক খুবলে টনকে টন পাথর তুলে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির বাউন্ডারি দেওয়ার কাজে। এভাবে জমির চারপাশে তৈরি হচ্ছে পাথরের বাউন্ডারি। আর ভেতরে খালি হয়ে যাচ্ছে দ্বীপের এমনিতেই দুর্বল ভিত্তিটি।
দ্বীপ কুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে এমন একটি জমির বাউন্ডারির বাইরে টাঙ্গানো আছে, ‘ক্রয় সূত্রে জমির মালিক দীন এম রানা’ নামের সাইনবোর্ড।
প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদ কর্মী সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সাইনবোর্ড পেরিয়ে একটু ভেতরে গিয়ে দেখা যায় তাজ্জব দৃশ্য। কয়েক ফুট মাটির নিচে গিয়ে পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত শতাধিক শ্রমিক। শ্রমিকদের মাঝি (সর্দার) টেকনাফ দমদমিয়া এলাকার মো. হোছনকে কতদিন ধরে পাথর উত্তোলনের কাজ করছেন প্রশ্ন করলে তিনি জানান, কোরবানির ঈদের দুইদিন পর থেকে দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরিতে এ কাজ করছেন।
শ্রমিক রহিম উল্লাহকে তাদের মালিকের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, মেজর সাহেবের কাজ করছেন তারা।
আরেক শ্রমিক আব্দুল্লাহকে ‘অবৈধ পাথর উত্তোলনের কাজ কেন করছেন’ প্রশ্ন করলে তিনি বেপরোয়া ভঙ্গীতে বলেন, ‘আমরা মেজর স্যারের কাজ করছি। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না। ’
মেজরের নাম কি জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘মেজর রানা স্যার’।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই জমির বাউন্ডারি নির্মাণ কাজে কর্মরত শ্রমিকদের কোনও ধরনের অসুবিধা হবে না বলে আগেই জানিয়ে দেওয়া আছে।
সূত্র মতে, মেজর রানা একা নন। সেন্টমার্টিনের দণি-পশ্চিমাংশের কয়েক একর জমির বাউন্ডারি নির্মাণ করা হয়েছে সাগরপাড়ের অবৈধ পাথর দিয়ে।
সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সরকার প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছে। এই দ্বীপে পাকা, সেমি পাকা ও বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে আগে আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এই আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও প্রভাবশালীরা তা মানছেন না।
স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, পরিবেশবাদীদের বাধা এবং চাপের মুখে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে বসবাসরত প্রায় ৭ হাজার স্থানীয়রা ইট-বালি দিয়ে নিজেদের মাথা গোজার ঠাঁইও নির্মাণ করতে পারেন না। কিন্তু টেকনাফস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে বহিরাগতরা ইচ্ছা মতো ইট, বালি, রড, সিমেন্ট নিয়ে বিভিন্ন প্রকার হোটেল-মোটেল-কটেজ নির্মাণ করে যাচ্ছে অবাধে। এ েেত্র সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সেন্টমার্টিনের অধিবাসীরা যেখানে বাসাবাড়ি নির্মাণের সামগ্রী পরিবহনের েেত্র হাজার আইনি বাধার মুখে পড়েন, সেখানে বহিরাগতদের েেত্র তা কার্যকর নয়। মেজর, কর্নেল, এমপি, মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে বিনা বাধায় রড, সিমেন্ট টেকনাফ-কক্সবাজার থেকে সাগর পথে সেন্টমার্টিন নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে বহিরাগতদের ইচ্ছার ওপরই চলছে সেন্টমার্টিনের সব আইন-কানুন। এ নিয়ে এলাকাবাসির মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। পরিবেশ ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে যত্রতত্র পাথর উত্তোলন করা হলেও এসব ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কোনও খবর নেই।
এ পটভূমিতে দ্বীপের ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৩ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানান দ্বীপের বাসিন্দা ও সচেতন পর্যটকরা।
এক অর্থে প্রবালপাথরই প্রবালের বিস্তীর্ণ বেলাভূমিবেষ্টিত সেন্টমার্টিনের অস্তিত্বের জন্য এখন হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন, পরিবেশবাদীরা কি সেন্টমার্টিন দ্বীপের দণি-পশ্চিমাংশের সংকটাপন্ন অবস্থার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন?
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে টেকনাফস্থ পরিবেশ কর্মকর্তা আব্দুল আমিন সাংবাদিকদের জানান, ‘পাথর উত্তোলনের বিষয়টি তার নজরে আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। ’
এদিকে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আহমদ এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১০