ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

তারা নেহেরুর বিরুদ্ধেও মরণোত্তর মামলা করতে পারে॥ অরুন্ধতী রায়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১০
তারা নেহেরুর বিরুদ্ধেও মরণোত্তর মামলা করতে পারে॥ অরুন্ধতী রায়

বুকার পুরস্কার পাওয়া লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ভারতের একটি আদালত মামলা (এফআইআর) করার নির্দেশ দিয়েছেন। কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্য করায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আদালত।

বেশ কয়েকদিন আগে কাশ্মীরে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় অরুন্ধতী রায় কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন। আর এ নিয়ে ভারত জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। লেখাটির বেশিরভাগই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে উদ্ধৃত করে রচিত হয়েছে। গত সোমবার এটি ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, নেহরু ছিলেন বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের প্রবাদপ্রতিম নেতা। লেখাটি অনুবাদ করেছেন রানা রায়হান।

আমার বিরুদ্ধে মামলার করার জন্য আদালত দিল্লি পুলিশকে আদেশ দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে আমার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে: সম্ভবত তাদের জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধেও মরণোত্তর মামলা করা উচিৎ। কারণ কাশ্মীর বিষয়ে বা পক্ষে বিভিন্ন স্থানে, সময়ে তিনি নানা কথা বলেছেন।

১. ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি টেলিগ্রামে বলেন, ‘আমার একটা বিষয় পরিষ্কার উচিৎ যে, জরুরি অবস্থার ভেতর কাশ্মীরকে সহায়তা করার প্রশ্নটা রাজ্যটিতে ভারতের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য নয়। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বারবার খোলাখুলিই বলেছি, যে কোনো বিতর্কিত ভূ-খণ্ডে বা রাজ্যে প্রবেশের সিদ্ধান্ত সেই অঞ্চলের জনগণের সম্মতি মেনেই নেওয়া হবে। আমরা এই সিদ্ধান্তই সমর্থন করি। ’ (২৭ অক্টোবর, ১৯৪৭)

২. আরেকটা টেলিগ্রামে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে নেহরু বলছেন, ‘মহারাজার সরকার ও রাজ্যের বিভিন্ন জনপ্রিয় মুসলিম সংগঠনের অনুরোধে ভারতে কাশ্মীর অন্তর্ভুক্তি আমরা মেনে নিয়েছি। এই শর্তে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, খুব শিগগির সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। কাশ্মীরের জনগণই কেবল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কোন দেশের নিয়ন্ত্রণে তারা যাবেন তা তাদের জন্যই খোলা থাকল। ’ (৩১ অক্টোবর, ১৯৪৭)

৩. অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সম্প্রচার করা ভাষণে পণ্ডিত নেহরু বলছেন, ‘সংকটের মুহূর্তে কিছু চূড়ান্ত করতে না পারায় এবং কাশ্মীরের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ না দিতে পারায় আমরা উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত এটা তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-- এবং আমি পরিষ্কার করে বলছি যে, একটি রাজ্য কার নিয়ন্ত্রণে যাবে এমন বিতর্ক যেখানে আছে সেখানে সেই অঞ্চলের জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণের দলিল নামে আমরা একটি বিধি যোগ করেছি। এই বিধি মোতাবেক এটা চলবে। ’ (২ নভেম্বর, ১৯৪৭)

৪. একই রেডিওতে ভাষণে নেহেরু বলছেন, ‘আমরা ঘোষণা দিয়েছি, কাশ্মীরের ভাগ্য চূড়ান্তভাবে সেই অঞ্চলের জনগণই নির্ধারণ করবে। এই অঙ্গীকার কেবল কাশ্মীরের জনগণের কাছে নয়, সারা বিশ্বের কাছে। এ অঙ্গীকার থেকে আমরা ফিরব না, ফিরতে পারব না। ’ (৩ নভেম্বর, ১৯৪৭)

৫. একটি চিঠিতে নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বলছেন, ‘আমি বারবার বলেছি, যখনই কাশ্মীরে শান্তি ও শৃঙ্খলা আসবে, তখনই জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’ (২১ নভেম্বর, ১৯৪৭)

৬. ভারতীয় সাংবিধানিক পরিষদে তার একটি বিবৃতিতে নেহরু বলছেন, ‘আমরা আমাদের আন্তরিকতার জায়গা থেকে প্রস্তাব দিয়েছি যে, জনগণ যখন তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ পাবে, তখন জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ সহিংসতা বা উন্মুক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে নাকি সেখানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে তাও চূড়ান্ত হবে। ’ (২৫ নভেম্বর, ১৯৪৭)

৭. সাংবিধানিক পরিষদের আরেকটি বিবৃতিতে নেহেরু বলছেন, ‘এমনকি অন্তর্ভুক্তির সময়েও আমরা এক তরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত ছিলাম। বলেছিলাম, কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা মেনে চলব। আমরা জোর দিয়ে বলেছিলাম যে, কাশ্মীরের সরকারকে অবশ্যই জনপ্রিয় সরকার হতে হবে। আমরা সবসময় এই মতের সঙ্গে ছিলাম এবং একটি স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান সুরক্ষিত করার মধ্য দিয়ে গণভোটের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ’ (৫ মার্চ, ১৯৪৮)

৮. লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনে পণ্ডিত নেহরু বলছেন, ‘কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ভারত বারবার জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব করেছে। এটা পরিষ্কার সত্য যে, কোনো দেশই কাশ্মীরের জনগণের সম্মতি ছাড়া সেই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে না। ’ (১৬ জানুয়ারি, ১৯৫১; ১৮ জানুয়ারি স্টেটসম্যানে প্রকাশিত। )

৯. অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির  কাছে পেশ করা প্রতিবেদনে নেহেরু জানান, ‘কাশ্মীরকে ভারত বা পাকিস্তানের জন্য পুরস্কারস্বরূপ বিবেচনা করা ভুল। লোকজন ভুলে যাচ্ছে যে, বিক্রি করা বা বাঁটোয়ারা করার মতো পণ্য নয় কাশ্মীর। এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে এবং জনগণই এর ভাগ্যনিয়ন্তা। ’(৬ জুলাই, ১৯৫১; ৯ জুলাই স্টেটসম্যানে প্রকাশিত। )

১০. জাতিসংঘের কাছে লেখা চিঠিতে পণ্ডিত নেহরু বলছেন, ‘ভারত সরকার এই নীতি কেবল পুনঃনিশ্চিত করছে না যে, জম্মু ও কাশ্মীরে রাজ্যের ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অর্থাৎ একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে সুরাহা করতে হবে। এতে অবশ্যই জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। ’ (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১)

১১. ভারতের পার্লামেন্টে ড. মুখার্জির একটি প্রশ্নের উত্তরে পণ্ডিত নেহরু বলছেন, ‘এটা পাকিস্তান বা ভারতের সম্পত্তি নয়। এটা কাশ্মীরের জনগণের সম্পদ। কাশ্মীর যখন ভারতকে মেনে নেবে, আমরা সেই অঞ্চলের নেতাদের উদ্দেশে বলতে চাই গণভোটের রায়ই আমরা মেনে চলব। যদি তারা চলে যেতে বলে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ছেড়ে চলে আসব। আমরা ইস্যুটি জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করেছি। একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি আমরা সম্মান জানাই। ’ (২ জানুয়ারি, ১৯৫২ অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত)

১২. ভারতীয় পার্লামেন্টে দেওয়া আরেকটি বিবৃতিতে পণ্ডিত নেহরু বলছেন, ‘আমার স্পষ্ট কথা হচ্ছে, কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ এর জনগণের সদিচ্ছার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। এই পার্লামেন্ট কাশ্মীর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্য রাখে না। কারণ এ নিয়ে কোনো কিছু আরোপ করলে আমরা আমাদের নীতি থেকে সরে আসব। কাশ্মীর আমাদের মনে, হৃদয়ের খুব কাছাকাছি রয়েছে। কোনো ধরনের অধ্যাদেশ বা বিরূপ পরিস্থিতি যদি একে ভারতের একটি অংশ হতে বাধা সৃষ্টি করে তা আমাদের তীব্র মোচড়, বেদনা, যন্ত্রণা দেবে। তবে যদি কাশ্মীরের জনগণ আমাদের সঙ্গে থাকতে না চান, তাহলে সর্বান্তকরণে তাদের যেতে দেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা তাদের আমাদের সঙ্গে রাখব না। তা যতই কষ্টের হোক আমাদের জন্য। আমি আবারও বলছি, কাশ্মীরের জনগণই তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। জাতিসংঘ বা কাশ্মীরের জনগণের কাছে এটা কেবল কথাই নয়, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসও। যত ব্যথারই হোক না কেন আমরা কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাব না। ’ (৭ আগস্ট, ১৯৫২)

১৩. ভারতের লোকসভায় নেহরু পৃথক একটি বিবৃতিতে নেহেরু বলছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভবত কাশ্মীরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমরা এটা মনে রাখার উচিৎ যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তর্কাতর্কির ইস্যু নয় কাশ্মীর। বরং এর একটা নিজস্ব আত্মা রয়েছে এবং রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কাশ্মীরের জনগণের সদিচ্ছা ও সম্মতি ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। ’ (৩১ মার্চ, ১৯৫৫; ১ এপ্রিল হিন্দুস্তান টাইমসে তার বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। )

১৪. ১৯৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৭৬৫তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের প্রতিনিধি কৃষ্ণা মেনন বলেন, ‘যতদূর আমরা জানি, পরিষদে দেওয়া কোনো বিবৃতিতে এমন একটা শব্দও পাওয়া যাবে না যার অর্থ করলে দাঁড়ায় আমরা আন্তর্জাতিক আইনী বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব না। রেকর্ড রাখার উদ্দেশে আমি বলতে চাই যে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এমন কিছুই বলা হয়নি যার দ্বারা এই ইঙ্গিত করে যে, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন মানবে না। ’

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।