ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৩ বছর

আইন ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মধ্যেই বন্দি রয়েছে চুক্তি

তুহিন শুভ্র অধিকারী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১০
আইন ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মধ্যেই বন্দি রয়েছে চুক্তি

ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন কেবল কতোগুলো আইন প্রণয়ন আর প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এবং তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে অধিকাংশ আইন ও প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা যায়নি।

ফলে গত ১৩ বছরে  বাস্তবায়িত হয়নি চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত।

অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে। চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে খুব শিগগিরই আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে চুক্তিতে স্বারকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। ইউপিডিএফ নামে অপর একটি পক্ষ এরই মধ্যেই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। চুক্তিতে সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও চট্টগ্রামের আধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি স্বাক্ষর করে।

চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে প্রণীত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮। একই বছর প্রণীত হয় তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ১৯৯৮। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কার্যবিধিমালা ২০০০ প্রণয়ন হয়।

তবে চুক্তি অনুযায়ী এসব আইনের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য পূর্বের বিধান সমূহ যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ -১৯৮২ এর সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা হয়নি যা আইনগত সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

অভিযোগ রয়েছে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন, সংযোজন না হওয়ায় পার্বত্য পরিষদসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ সময়ই পরিষদসমূহে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে ‘অগণতান্ত্রিকভাবে’ চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়।

এবছর ১৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের কতিপয় ধারাকে অবৈধ এবং সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৯ (১) ও ৩১ অনুচ্ছেদ ও একক রাষ্ট্রের পরিপন্থি ঘোষণা করেন।

এর ফলে চুক্তিটি তথা এর বিধানাসমূহ আদৌ বলবৎ রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। অবশ্য বর্তমানে এই রায়ের উপর আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বাংলানিউজকে বলেন, চুক্তির আওতায় আঞ্চলিক পরিষদকে প্রভিধান (সাব রুল) তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রায় ৫-৭ বছর আগে এ প্রবিধান তৈরি করে সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে আঞ্চলিক পরিষদ। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে জেলা পরিষদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে আঞ্চলিক পরিষদ।

এ চুক্তির আওতায় ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বরাবরই একজন আদিবাসী সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও এ মন্ত্রণালয় পার্বত্যবাসীর স্বার্থরক্ষা ও পার্বত্যচুক্তি বাস্তবায়নে ততোটা কার্যকর নয় বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে।
 
গত ২৯ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পার্বত্যবাসী এবং চুক্তিবিরোধী ভূমিকার জন্য এ মন্ত্রণালয়কে অভিযুক্ত করেন।

এ মন্ত্রণালয় চুক্তি বাস্তবায়নের তুলনায় পার্বত্যবাসীর স্বার্থ-বিরোধী ও চুক্তি পরিপন্থী ভূমিকা পালন করে চলেছে বলেও সেসময় তিনি অভিযোগ করেন।

তবে চুক্তি বস্তবায়ন বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার সম্প্রতি একটি পত্রিকায় বলেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে আন্তরিক। এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে যা চুক্তি বাস্তবায়নের মৌলিক কাজ শুরুর পটভ’মি সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় জেএসএস’র উচিত সরকারকে আস্থায় নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। তা না হলে চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তার দায় জেএসএসকেই নিতে হবে।

বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী রাঙামাটিতে অবস্থান করায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

১৯৯৯ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ যার জন্য আইন প্রণীত হলেও কার্যবিধিমালা প্রণয়ন ঝুলে থাকায় এটি কার্যকর হতে পারছে না। প্রতিষ্ঠা করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন টাস্কফোর্স যা এ সরকারের আমলে আবার পুনর্গঠিত হয়েছে। তবে এ টাস্কফোর্সে সঙ্গে জনসংহতি সমিতির সমন্বয়হীনতার অভিযোগ রয়েছে যা পুর্নবাসন কার্যক্রমকে জটিল করে তুলেছে।

এছাড়া পার্বত্য সমস্যার অন্যতম ভূমি সমস্যা সমাধানে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন ও প্রণীত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১। তবে ভূমি কমিশন এখন পর্যন্ত বিধিমালাই তৈরি করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ২২টি ধারা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যা সংশোধনে সরকার নীতিগত সমর্থন দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এছাড়া শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি। তবে জনবল, কার্যালয় ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাবে কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গৌতম দেওয়ান বলেন, এসব আইনগত জটিলতা ও প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ সমস্যা চুক্তি বাস্তাবায়নে সরাসরি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। যার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। কেবল সরকারের সদিচ্ছাই পারে এসব সমস্যা সমাধান করে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।