ঢাকা: মিরপুর সাড়ে এগারোর সিটি ক্লাবের গেটের দারোয়ান আব্দুল করিম সোমবার বিকেলে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খুঁজছেন ছেলে হোসেনকে।
স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে দুই জমজ ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন ঠিকই আব্দুল করিম। তবে জানেন না সেই মাদ্রাসার নাম। নিজের মোবাইল নেই। একটি চিরকুটে লেখা হোসেন এবং একটি ফোন নাম্বার। দেখিয়ে বলেন, “এটাই মাদ্রাসার ফোন নাম্বার, এখানে ফোন দিলে পাওয়া যায় হোসেন এবং হাসানকে। ” জমজ দুই সন্তানের নাম দিয়েছিলেন হাসান ও হোসেন।
বরিশালের করিম জানান, পল্লবী থানার পরে মোসলেম বাজারের মাদ্রাসায় বছর তিন আগে দুই ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন তিনি। দুজনেই এখন হাফেজি পড়ছে সেখানে। হাসান কয়েক ঘণ্টার বড়। রোববার ওই মাদ্রাসা থেকে প্রায় কয়েকশত ছাত্র যোগ দেয় হেফাজতের ঢাকাও ঘেরাও কর্মসূচি ও সমাবেশে।
মতিঝিলে হেফাজত ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছে, রোববার এমন সংবাদ পেয়ে ওই মাদ্রাসায় যান করিম। দেখা মেলে আরেক ছেলে হাসানের। হাসান জানায়, সকাল আটটায় মাদ্রাসায় সকলে ভাত খেয়ে সমাবেশের জন্যে বেরিয়ে পড়েছিল। দুই ভাইও বেরিয়েছিল। সে বের হলেও পরে ঘুরে-ফিরে আবার মাদ্রাসায় চলে আসে। কিন্তু হোসেনের আর কোনো খোঁজ নেই। সোমবার সকালেও অনেকে ফিরে আসে মাদ্রাসায়, কিন্তু হোসেন এখনো ফিরেনি। সকাল থেকে কয়েকবার ওই মাদ্রাসায় গিয়েছেন করিম, কিন্তু ছেলের দেখা মিলছে না। ভয়ে কথা বলতে পারছেন হুজুরদের সঙ্গে। কথা বলতে গেলে ধমক দেয় এই দরিদ্র লোকটিকে।
![Abdul-Karim Abdul-Karim](../../../images/PhotoGallery/2013May/Abdul-Karim-Photo20130506083822.jpg)
প্রতিবেদকের সহায়তায় একটি মোবাইল থেকে ফোন দেয়া হয় চিরকুটে লেখা মাদ্রাসার নাম্বারটিতে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে হুজুর বলেন, তিনি এখনো জানেন না। বাইরে ব্যস্ত আছেন। পরে ফোন দিয়েন বলে রেখে দেয় ফোন।
করিম জানান, এই ফোন গ্রহণকারী ব্যক্তিটি মাদ্রাসায় আজান দেন। ৬ ছেলে, ৪ মেয়ে আর স্ত্রীসহ ১২ সদস্যের পরিবার ছিল করিমের। প্রথম ছেলে অনেক আগে মারা গেছে। একটি সন্তানকেও পড়াশোনা করাননি তিনি। অভাবের জন্যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো হয়নি বলে জানান। তাহলে এতগুলো সন্তান নিলেন কেন? জানতে চাইলে শুধু লজ্জা পাওয়ার ভাব প্রকাশ করেন তিনি।
সিটি ক্লাবের এই দারোয়ানের আরেক ছেলে কামালও খুঁজছেন ছোট ভাইকে। তাকে ফোন দিলেও তিনি জানাতে পারেননি হোসেনের মাদ্রাসার নাম। হোসেন কোনো সহপাঠীর সঙ্গে অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানালো কামাল।
হোসেন ও হাসান পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে তাদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন করিম। কারণ সর্ম্পকে বলেন, “সওয়াবের জন্যে। ” বলেন, হাসান একটু চালাক হলেও, হোসেন ছিল খুবই সহজ সরল। যে যেখানে বলতো, সেখানে যেত। যে যা করতে বলতো, তাই করতো। করিম জানান, হুজুররা সপ্তাহে একবারের বেশি তার সন্তানদের বাসায় যেতে দেন না।
সোমবার সকালে কাচপুরে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতের সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে গুলিতে নিহত হন ১৬ বছরের মার্জানুল ইসলাম। এ বছর সানপাড়া শেখ মূর্তুজা আলী হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল সে। ঢামেক মর্গের সামনে অপেক্ষা করা পরিবারের সদস্যরা বেশ সম্ভ্রান্ত হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে নারাজ। মেধাবী ছাত্র মার্জানুল ৫ম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগরের মাদ্রাসায় মাওলানা হওয়ার জন্য তালিম নিচ্ছেন মার্জানুলের বড় ভাই আশিক। এনামুলের হকের তৃতীয় সন্তান আশিকই ছোট ছেলে মার্জানুলকে নিয়ে সকালে বেরিয়েছিল হেফাজতের মিছিলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মার্জানুল ছিলেন সকলের ছোট। পারিবারিক সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, ছোট বেলা থেকেই দুষ্টু স্বভাবের ছিল আশিক। এক সময় তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। মাদ্রাসার হুজুরদের থেকে পাওয়া জ্ঞান তাকে উদ্বুদ্ধ করে ছোট ভাই মার্জানুলকে নিয়ে হেফাজতের মিছিলে যেতে। কওমী মাদ্রাসা শিক্ষায় দীক্ষিত আশিক মনে করছেন তার ভাই শহীদ হয়েছে।
রোববার সকালে বৃষ্টির বাড়লে যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থান নেওয়া হেফাজত কর্মীদের কয়েকজন অবস্থান নেন বন্ধ থাকা একটি দোকানের ছাউনিতে। তাদের আলাপের বিষয় ছিল ‘খোদার গজব নিয়ে। ’
একজন আরেকজনকে বলেন, “২৭ এপ্রিল গণজাগরণ মঞ্চ নারী সমাবেশের ডাক দেয়াতে খোদার গজব পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজায়। তাই সেখানে এতো নারী মারা যায়। ” আলোচনাকারী হেফাজত কর্মীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তার কোন নারী আত্মীয় মারা গেলে তিনি এ কথা বলতেন কিনা? কোনো জবাব দেননি দুজনের কেউই। ”
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে দেশে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৩১টি। ২০০৮ সালে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশ তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত এক গবেষণায় কওমী মাদ্রাসায় সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। কিন্তু কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ২০ লাখের ওপর হবে।
এসব মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা ছাড়া বাংলা, ইংরেজি, অংক, গণিত কোন বিষয়েরই শিক্ষা দেওয়া হয় না। দেয়া হয় ফার্সি, উর্দু ভাষা শিক্ষা। দীর্ঘদিন ধরে এ শিক্ষা মাধ্যমকে পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের দাবি জানিয়ে অাসছে শিক্ষাবিদরা। কিন্তু আলেমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও নিজেদের স্বার্থে মাদ্রাসাগুলোতে কোনো ধরনের সরকারী হস্তক্ষেপ করতে দিচ্ছে না মাদ্রাসা পরিচালনাকারী হুযুরেরা। বিভিন্ন সময়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যাবহার করছে তারা।
বাংলাদেশ সময় ১৯৩৫ ঘন্টা; মে ০৬, ২০১৩
এমএন