ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রোড টু মালয়েশিয়া

ঢাকাইয়া পোলা-ইন্দোনেশিয়ান মাইয়্যা

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৩
ঢাকাইয়া পোলা-ইন্দোনেশিয়ান মাইয়্যা

আমপাং, কুয়ালালামপুর থেকে: ২০০৯ সালের পর থেকে নূরী রানী সুকর্ণের সঙ্গে আর দেখা হয়নি মামুনের। ফোনে কথা হলেও সীমান্তের বাধা এক হতে দেয়নি এই দম্পতিকে।

সন্তান নিয়ে সুখের সংসার নয় বরং নিজেদের মালয়েশিয়ায় টিকিয়ে রাখতেই একসময় আলাদা হয়ে যেতে হয় তাদের। নতুন করে সংসার পাতলেও সেই সংসারে সুখে নেই নূরী।

শুক্রবার সন্ধ্যায় আমপাংয়ে একটি চাইনিজ রেঁস্তোরায় জমে এই আড্ডা। মামুন ছাড়াও রয়েছে মুগদাপাড়ার তরুণ রাজু।

১৭ বছর আগে কুয়ালালামপুরে আসেন ঢাকার মুগদাপাড়ার ছেলে মামুন। জানালেন ইন্দোনেশিয়ার সলো অঞ্চলের মেয়ে নূরীর সঙ্গে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে এরপর দুজনের দূরে সরে যাওয়ার ইতিকথা।

দীর্ঘ আড্ডায় জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের কাছে বরাবরই বাংলাদেশি তরুণেরা অনেক বেশি রোমান্টিক। তারা মনে করেন ভারতীয়, আফ্রিকান বা চায়নিজদের তুলনায় বাঙালি ছেলেরা প্রেমিকার জন্যে ত্যাগ করতে পারেন অনেক বেশি।

আবার বাঙালি ছেলেদের কাছেও আকর্ষণীয় ইন্দোনেশিয়ান মেয়েরা। তাদের রূপ আর ছলা-কলা পাগল করে বাংলাদেশ থেকে আসা হিরোদের। আর ধর্মীয় পাল্লাতেও ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপাইনের মেয়েদের সঙ্গে জোড়া বাধে এখানে অবস্থানরত তরুণেরা।

মালয়েশিয়ায় পৃথিবীর অনেক জাতের মিশ্রন ঘটেছে। রাস্তায় নেমে বোঝা যাবে না, এখানকার সত্যিকারের অধিবাসী কারা, কি তাদের ধর্ম বা সংস্কৃতি।

জীবিকার প্রয়োজনে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছেন কোটিরও ওপরে নারী-পুরুষ। আধুনিক মালয়েশিয়া গড়তে অবদান রেখেছে সব জাতিই। বাংলাদেশিদেরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান।

ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসী এসব নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেম। বাকি জীবন একসঙ্গে কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে হাতে হাত রাখলেও, এক সময় মোহ ভাঙে যখন ভিসা জটিলতায় পড়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব।

শুরু হয় গল্প, জমে ওঠে আড্ডা।
 ১৯৯৭ সাল। ফোন দিতে গিয়ে ক্রস কানেকশন হয়ে যায় মামুনের। অপর প্রান্তে নারী কণ্ঠে মালয়ী ভাষা শুনে ক্রস কানেকশনেই কথা বলা শুরু করেন বাঙালি রোমান্টিক বয়।

এরপর সত্যিকারের ফোন নাম্বার নিয়ে জমে উঠে কথার মালা। কথার পিঠে কথা পড়ে। নূরীও সায় দেয় মামুনের প্রেম প্রেম ভাবকে।

মামুনের জন্যে তখন কুয়ালালামপুরের আকাশ স্বর্গের মতো। নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এতোদিন প্রবাসের সব বন্ধুদের ইন্দোনেশিয়ান মেয়ে বিয়ে করার ঘোর বিরোধীতা করলেও এখন নিজেই জড়িয়ে পড়ছেন জালে।

নিজের ছবি তুলে চিঠির খামে ভরে সেটি পোস্ট করে দেন সুবাংজায়া প্রদেশে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে চাকররত নূরীর কাছে। ফিরতি খামে নূরীর ছবি দেখে মুখে হাসি ফোটে মামুনের।

এরপরের ২ বছর শুধুই ফোনের। দু’জনের আয় এরই মধ্যে বাড়তে থাকে। কুয়ালালামপুর মিউনিসিপ্যাল এ চাকরি করা মামুনের কাজের চেয়ে তখন প্রেয়সীর ছবি সামনে রেখে ফোনে কথা বলাই বেশি উপভোগ্য।

মামুন বলেন, ভাই এমন দিনও গেছে, ২৪ ঘণ্টা কথা কইছি।

২ বছর পরে দেখা হয় কপোত-কপোতীর। সুবাংজায়া থেকে ছু’টি নিয়ে আসেন নূরী।

মামুন বলেন, এরপর আরো অনেকবার দেখা হয়। হয় নূরী আসতো নইলে আমি যাইতাম। তবে বেশি সময় থাকা হইতো না একসঙ্গে। তখন আবার কাজের চাপ বেশি।

নূরীকে অন্য ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের থেকে আলাদা বিচার করেন মামুন।

৯৬ সালে মালয়েশিয়া আসার পর আর দেশে ফেরা হয়নি মামুনের। অবশেষে ২০০৫ সালে দেশে ফেরে। ৩ মাস থেকে আবার কুয়ালালামপুর আসে। এরই মধ্যে নিজের বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছেন নূরী।

 ২০০৬ সাল। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ইন্দোনেশিয়ান বাবা-মা রাজি হয়ে যান। কিন্তু বাঙালি বাবা-মা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এ ধরনের কিছু হলে মামুন যেন আর দেশে না ফিরে।

কিন্তু প্রেম তো আর গোলাপের পাঁপড়ি নয়, যে একটু আঘাতেই ঝরে যাবে! নিজেরাই বিয়ে সেরে নেন মামুন আর নূরী।

সুখের অভাব না হরেও একসঙ্গে সংসার জমাতে পারেননি তারা। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিন মামুনের কাছে এসে থাকতেন নূরী।

২০০৮ সালে প্রথম সন্তান সম্ভবা হন নূরী। কিন্তু চাকরি টিকিয়ে রাখতে নিজেদের প্রথম সন্তানের ভ্রুণ হত্যা করতে হয় তাকে। কারণ তার পাঠানো অর্থেই চলে দেশে তার বাবা-মায়ের পেট। আর চাকরি থেকে ছাটাই হলে, এখানকার ভিসাও বাদ হয়ে যাবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে মামুনের কাছ থেকে।

মামুন বলেন, ওই সময়টা ছিল খুব কষ্টের। নূরীর কান্না থামতো না। অনেক কষ্টে আমাদের ওই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

এদিকে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ছে মামুন। আগামী বছরই তার ১৩ বছরের ওয়ার্কিং ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। মেয়াদ বাড়াতে আবেদনও করেন তিনি। ভেবেছিরেন এক বছরের মধ্যেই হয়ে যাবে। এই বছরটা খুব দ্রুতই শেষ হতে থাকে।

২০০৯ সাল। আবারো গর্ভে সন্তান আসে নূরীর। এবার মেয়ে সন্তান। তবে যাই হোক, এবার সন্তান ধারণ করবেন বলেই স্বিদ্ধান্ত নেন তিনি। মামুনও রাজি। তবে দু’জনকে ভাবায় তাদের চাকরি আর ভিসা।

নূরী অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসে মামুনের কাছে। ফেব্রুয়ারি থেকে পরের ৪ মাসই ছিল টানা একসঙ্গে তাদের সংসার করা। দ্রুত শেষ হতে থাকে মামুনের ভিসার মেয়াদ। অবৈধ হওয়ার পথে এগোতে থাকেন তিনি।

কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের। নূরী ফিরে যায় ইন্দোনেশিয়ায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগত কন্যা শিশুটি কিছুটা বড় হলে, নানীর কাছে রেখে আবারো মালয়েশিয়াতে ফিরে আসবেন তিনি। এর মধ্যেই মামুনের ভিসা নবায়ন হয়ে যাবে। মামুনই গিয়ে নিয়ে আসবেন নূরীকে।

দেশে ফিরে ফুটফুটে এক কন্যারর জননী হন নূরী। মামুন মেয়ের নাম রাখেন ‘লামহা’।

ভিসা
২০১৩ সালের শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন মামুনের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে, তখন পর্যন্ত ভিসা হয়নি তার। বারবার ইন্দোনেশিয়া গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসতে শ্বশুর-শাশুড়ি তাড়া দিলেও মামুন আর নূরী জানে সেটি সম্ভব নয়। কারণ মামুনের মতো নূরীর ভিসাও ২০১০ থেকে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

মামুনের অপেক্ষায় ইন্দোনেশিয়ায় থাকা নূরীর ভিসাও ততদিনে বাতিল করে দেয় কোম্পানি।

এ বছরের প্রথম দিকেই ইন্দোনেশিয়ান পুরুষের সঙ্গে নূরীকে বিয়ে দেয় তার পরিবার।

নূরী-মামুনের সন্তান লামহার বয়স এখন ৪ বছর। নূরী এখনো ফোন দিয়ে কথা বলে মামুনের সঙ্গে। নতুন বর অন্য ইন্দোনেশিয়ান পুরুষদের মতোই কুড়ে আর স্ত্রীকে পাঠায় আয় করতে। লামহা ফোনে কথা বলে মামুনের সঙ্গে।

মামুন বলেন, দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাস্তবতা মেনে নিয়েছি এখন। দেশে গিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করবো।

মামুন আশা করছেন এ বছরই ভিসা নবায়ন হবে তার।

মামুন, রাজু জানান, এখানে বাঙালি ছেলে আর ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের সংসারগুলো এভাবেই ভেঙে যায়। তবে টিকেও যায় অনেক সংসার।

ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতিতে পুরষেরা বাসায় থাকে আর মেয়েরা কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। এদিক থেকে বাঙালি ছেলেরা অনেক বেশি পরিশ্রমী। নিজেদের কষ্ট লাঘবের জন্যেই বাঙালি ছেলেদের অনেক বেশি পছন্দ ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৩
এমএন/এসএটি/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।