ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

উলফা জঙ্গিদের প্রেম-বিয়ে-আত্মীয়তা, আদিবাসী মেয়েদের কপাল পুড়ছে

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১০
উলফা জঙ্গিদের প্রেম-বিয়ে-আত্মীয়তা, আদিবাসী মেয়েদের কপাল পুড়ছে

উলফা নেতা রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মাসুদ রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে টানা তিন বছর প্রেম করে ১৯৯৮ সালে ঘর বেঁধেছিলেন শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার মরিয়মনগর গ্রামের গারো মেয়ে সাবিত্রী হাগিদক। এরই মধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছেন তিনি।

কিন্তু প্রেমিক রঞ্জন চৌধুরী যে বাংলাদেশি নাগরিক নন---তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি সহজ-সরল এই আদিবাসী তরুণী। বাংলাদেশি ছদ্মবেশের আড়ালে স্বামী রঞ্জন যে আসলে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন উলফার অস্ত্রবাজ কমান্ডার সেটা জানতে পেরে তার আক্কেল গুড়ুম।


সাবিত্রী জানতেন রঞ্জনের বাড়ি জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ থানার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম বালিয়াজুড়িতে।   এক পর্যায়ে রঞ্জন তাকে জানান, সপরিবারে তারা মেঘালয় রাজ্যে পাড়ি জমিয়ে সেখানেই ঠাঁই গেড়েছেন। শুধু সাবিত্রী নন, তার পরিবার ও গ্রামবাসী এমনটাই জেনে এসেছেন দীর্ঘকাল। কিন্তু বিয়ের পর এক যুগ পার হওয়ার পরও রঞ্জন তার কথিত গ্রাম বালিয়াজুড়িতে সাবিত্রীকে নিয়ে যাননি।

২০০৪ সাল...কিছুটা সন্দেহ
স্বামীর আসল পরিচয় নিয়ে কিছুটা সন্দেহ তার মনে জাগে ২০০৪ সালে উলফা ক্যাম্প থেকে গ্রেনেড খোয়া যাওয়ার পর আদিবাসী গ্রামগুলোতে রঞ্জন-বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসার পর। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এসব খবর তার কাছেও আসতে থাকে।   কিন্তু ধূর্ত রঞ্জন একথা সেকথা  বলে সাবিত্রীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করেন। কিন্তু ধর্মের কল পুরোপুরি নড়ে ওঠে গত ১৭ জুলাই। কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে র‌্যাবের হাতে এক সহযোগীসহ গ্রেফতার হন রঞ্জন চৌধুরী ওরফে মাসুদ রঞ্জন চৌধুরী। সাবিত্রী হাগিদক তবু নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

তবু ওকে চিনতে পারিনি...
সাবিত্রীর বক্তব্য, ‘১৩ বছর ধরে যার সংসার করছি, এক বেডে ঘুমাচ্ছি- এরপরও ওকে চিনতে পারলাম না ! মাসুদ রঞ্জু চৌধুরী যে ওর ছদ্মনাম এর ঘুণারেও টের পেলাম না !’ কিন্তু স্বামীর সব ছদ্মবেশ যখন উন্মোচিত হলো, জানা গেল তার প্রকৃত নাম মেজর রঞ্জন চৌধুরী- --বাড়ি আসামের ধুবরি জেলার এক গ্রামে। তখন আর সাবিত্রীর কিছুই করার ছিল না। তিনি নিজেই যেন আট্কে পড়েছেন অন্ধকার ভবিষ্যত আর অনিশ্চয়তার জালে...।

ভালোবাসার ফাঁদে আরো তিন শতাধিক আদিবাসী সরলা
সীমান্তবর্তী বিভিন্ন আদিবাসী পল্লীর তিন শতাধিক আদিবাসী মেয়েরও অবস্থা সাবিত্রীর মতোই।   মিথ্যা পরিচয়ধারী আর ভুয়া ঠিকানার যুবকদের ভালবাসার ফাঁদে পা দিয়ে এরা সবাই এখন পড়েছে সীমাহীন বিপাকে। এদেরই একজন নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা থানার নলচাপড়া গ্রামের আরতী ম্রং। তিনি বিয়ে করেছিলেন আসামের ধুবড়ি এলাকার বাসিন্দা উলফা জোন কমান্ডার নৃপেন মারাককে।

সীমান্ত ঘেঁষে বসবাসকারী বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসী মেয়েরাই শুধু নয়, ভালবাসার ছলে সীমান্তঘেঁষা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের পাহাড়ি আদিবাসী মেয়েদের বিয়ে করে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে নিচ্ছে উলফা দুর্বৃত্তরা। নেত্রকোণার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট প্রভৃতি এলাকার গারো ও কোচপাড়াতেও বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় দুর্বত্ত জামাইরা বেজায় দাপটের সঙ্গেই বসবাস করে চলছে।

মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া পাহাড়ঘেঁষা টিপড়াপাড়ার মেয়ে কাজল রেখা বিয়ে করেন ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএলএফটির (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা) কমান্ডার রাজকান্ত দেব বর্মাকে।   র‌্যাবের অভিযানে রাজকান্ত গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ভারতে পুশব্যাক করা হয়েছে। কিন্তু তিন সন্তান আর কাজল রেখার কথা রাজকান্তের ভাববার সময় কোথায়? ভারতীয় উগ্রপন্থীদের ভালবেসে বিয়ে করলে কেমন যন্ত্রণা পোহাতে হয় তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন কাজল রেখা।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আদিবাসী তরুণী মিয়াদ খাসিয়ারও স্বপ্ন ভেঙেছে তাসের ঘরের মত। আদমপুর ইউনিয়ন এলাকার প্রভাবশালী দিলীপ খাসিয়ার ছোট বোন মিয়াদ খাসিয়ার সঙ্গে উলফা জঙ্গি বরুণ দেব বর্মার প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। একপর্যায়ে উভয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। নয় মাস বয়সের এক কন্যা সন্তান কোলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দিন কাটান মিয়াদ। স্বামী বরুণ ওরফে পাগলা গত ৬ মাস ধরেই উধাও।

কারো কারো ধারণা প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ত্রাসীরা বরুণকে হত্যা করেছে। আবার কারো কারো ধারণা, সে ভারতীয় বিএসএফ এর হাতে ধরা পড়েছে। কিন্তু মিয়াদ খাসিয়া তার বুকে নিষ্পাপ শিশুকে আঁকড়ে ধরে এখনো পথ চেয়ে থাকেন স্বামী বরুন বর্মার। মিয়াদ ভাবেন, হয়তো কোনো এক গভীর রাতে স্বামী তার ফিরে এসে দরজায় কড়া নাড়বে। কিন্তু মিয়াদ খাসিয়ারা জানেন না, বরুণ দেব বর্মার মতো ভিন্দেশি উগ্রপন্থিরা একবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আর কখনই ফিরে আসে না।

আদমপুরের কালিঞ্জি পুঞ্জির মন্ত্রী বট খাসিয়া সম্মতিতে তার বাড়িতে রীতিমত আস্তানা বানিয়ে বসেছিল ভারতীয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুর্বৃত্তদের নজর পড়ে বট খাসিয়ার মেয়ে দিয়ানের উপর। গভীর রাতে দিয়ানকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে- এর পর থেকে আর তার খোঁজ মেলেনি। দুর্বৃত্তরা এ ঘটনার পর নিজেদের আস্তানা গুটিয়ে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ায় দিয়ানের বর্তমান পরিস্থিতি কি- তাও জানতে পারছেন না তার বাবা-মা।

ভুয়া ঠিকানার আরেক ভিনদেশি যুবককে বিয়ে করে কপাল পুড়েছে কুলাউড়ার আদিবাসী মেয়ে তিথী খাসিয়ার। ফুলতলা কিপ পুঞ্জির মেয়ে তিথী খাসিয়া নিজের পছন্দেই বিয়ে করেন ভারতের  মনিপুর রাজ্যের মতৈই সম্প্রদায়ের যুবক রোমিওকে। সে উলফার দলছুট সদস্য। এর আগে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের পোড়াবাড়ি এলাকায় র‌্যাব-বিডিআরের অভিযানে অন্য ৫ জন দুর্বৃত্তের সঙ্গে রোমিও নিহন হন। সেই সঙ্গে চিরস্থায়ী অমাবশ্যার তিথি নেমে এসেছে তিথি  ও তার এক সন্তানের জীবনে। রোমিও’র বেঁচে যাওয়া সঙ্গীদের সঙ্গে এক টিলা থেকে আরেক টিলা, এক বন থেকে আরেক বনের আস্তানায় পালিয়ে জীবন কাটছে তার।

ভারতীয় জঙ্গিদের প্রেমের ফাঁদেপড়া আদিবাসী মেয়েদের দু:খগাথা লিখে শেষ করা যাবে না। আরব্য রজনীর গল্পের মতোই তা অন্তহীন।

‘পরদেশি জামাইরা’ সীমান্তবর্তী আদিবাসী পল্লীগুলোর জন্য বড় আপদ হয়ে  হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা উগ্রপন্থী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার কারণে সীমান্তের ওপার (মেঘালয় ও আসাম) থেকে রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা আসা-যাওয়া করে। আবার তারা চলে গেলেই শুরু হয় জেলা ও থানা প্রশাসন, পুলিশ আর গোয়েন্দাদের খবরদারি।

বাংলাদেশ সময় ১৯৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।