মৌলভীবাজার: গত জোট সরকারের তুমুল প্রভাবশালী ব্যক্তি তথা বিএনপির অন্যতম নীতিনির্ধারক হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়? দলের রাজনীতিতে নেপথ্য নায়ক হিসেবে সমধিক পরিচিত, জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন দাপিয়ে বেড়ানো হারিছ চৌধুরী কেমন আছেন?
হারিসের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে- তিনি দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত।
এ অবস্থায় সিলেট-মৌলভীবাজারের বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে- হারিস চৌধুরী কি আসলেই অসুস্থ?
প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলছে না কারো কাছেই।
তার একসময়ের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, হারিছ চৌধুরীর জীবনে এমন আত্মগোপন এবারই প্রথম নয়। এর আগেও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন তিনি। এরপর রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে কয়েক বছর বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে।
জানা গেছে, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হারিছ চৌধুরী শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। যুবলীগ নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় ভাই শেখ কামালের সঙ্গেও ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শেখ কামালের হাত ধরে সক্রিয় হন যুবলীগের রাজনীতিতেও। পরে ৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগদলে।
পরবর্তী সময়ে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহ-সভাপতিসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
এদিকে, এক এগারোর পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিকূল প্রেক্ষাপটে দেশছাড়া সব রাজনৈতিক নেতাই একে একে দেশে ফিরলেও ফেরেননি হারিছ চৌধুরী। তাদের প্রায় সবাই, এমন কী সাজাপ্রাপ্ত সব নেতাও দেশে ফিরে জামিনে মুক্তি পেয়ে, রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হলেও ব্যতিক্রম কেবল হারিছই।
দলীয় নেতা-কর্মী, শুরু করে স্বজন আর ঘনিষ্ঠজন থেকে নিয়ে হারিছ চৌধুরীর পরিবারের সদস্য এমনকি খোদ আইন-শৃংখলা বাহিনীর কেউ তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারছেন না।
সর্বশেষ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় হারিছ চৌধুরীর জড়িত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর তাকে ঘিরে নানা গুঞ্জন এখন ফের ডালপালা মেলছে সিলেটের সর্বত্র।
বিরাজমান পটভূমিতে আপন ভাই থেকে শুরু করে এক সময়ে হারিসের একান্ত ঘনিষ্টজনরাও এখন হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে মন্তব্য করতে নারাজ।
বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব ও দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে গত চারদলীয় জোট সরকারের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি হারিছ চৌধুরীর পরিচয় স্বীয় দলে এখন ‘সাবেক নেতা’ হিসেবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে সিলেট জেলা কমিটি- --দলের কোনও পর্যায়েই এখন আর রাখা হয়নি তাকে।
আর হারিছ চৌধুরীর পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ১/১১’র পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশত্যাগ করা হারিছ চৌধুরীর খুব শিগগিরই দেশে ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই।
তার এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘এ সরকারের আমলে হারিছ চৌধুরী আর দেশে ফিরছেন না। এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ’
তিনি আরো জানান, আত্মগোপনে থেকেও ভাল নেই হারিছ চৌধুরী। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঢাকার গুলশানে স্ত্রী জোছনারা চৌধুরীর নামে হারিছ চৌধুরীর একটি বিলাববহুল ফ্লাট আছে। ফ্লাটের ভাড়াটিয়া ১/১১’র আগে পর্যন্ত হারিছ চৌধুরীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতেন। তিনি আত্মগোপনে যাবার পর গত কয়েক বছর ধরে ওই ভাড়াটিয়া আর ভাড়াই দিচ্ছেন না।
তার মেয়ে সামিরা তানজিম ফ্লাটটি দখলমুক্ত করতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে দফায় দফায় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ও চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছেন।
এদিকে কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে- দুর্নীতিসহ কয়েকটি মামলায় এরই মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত এ নেতা বর্তমানে ফেরার অবস্থায় দিন কাটালেও বিএনপির দু’জন নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাসহ ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে ফোনে ও ফেসবুকে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখছেন তিনি ।
গত বৃহস্পতিবারও হারিছ চৌধুরীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বন্ধু তালিকায় যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানসহ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতার নাম দেখা গেছে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, এক এগারোর পরে হারিছ চৌধুরী ভারতের করিমগঞ্জের কাঠিগড়া গ্রামে তার মামাবাড়িতেই বসবাস করতেন । ভারতের করিমগঞ্জ শহরে তার মামাবাড়ি থেকে সীমান্ত পথে হারিছ চৌধুরীর কানাইঘাটের বাড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটারের। গত বছরের মধ্য এপ্রিলে তার দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পনের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করেননি তিনি।
একাধিক সূত্র দাবি করেছে, হারিছ চৌধুরী আত্মগোপনের পর ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সর্বশেষ আলাপকালে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই ও কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, `হারিছ চৌধুরী ও তার স্ত্রী কোথায় সে বিষয়টি আমরাও জানি না। আমাদের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই। শুনেছি তিনি অসুস্থ। তবে আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি দেশে ফিরবেন এটা নিশ্চিত। `
তিনি আরো জানান, হারিছ চৌধুরী গত ১০ বছর ধরেই দূরারোগ্য চর্মরোগে (স্কিন ক্যান্সার) আক্রান্ত। এর আগে দু’দফায় আমেরিকায় গিয়ে অস্ত্রোপচারও করিয়েছেন। এখন তার সেই চর্মরোগ শরীরের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে।
তার ভাই (হারিছ চৌধুরী)এখন সিঙ্গাপুরে ,না ব্যাংককে আছেন সেটা তিনি জানেন না বলেও দাবি করেন।
হারিছ চৌধুরীর একসময়ের ঘনিষ্ঠজন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা, সিলেট অঞ্চলে জাপার অন্যতম নীতিনির্ধারক লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, `হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন সেটি আমার জানা নেই। তবে শুনেছি তিনি অসুস্থ। `
হারিছ চৌধুরীর আপন ভাই সেলিম চৌধুরী বলেন, ‘উনি কোথায় আছেন সত্যিই আমরা জানি না। তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ’
এদিকে, সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার একজন সহকারী পরিচালক বৃহস্পতিবার বলেন, `হারিছ চৌধুরীর ব্যাপারে কয়েকটি দেশে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। ওয়ান ইলেভেনের পর তিনি ভারতে ছিলেন। এরপর তিনি সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে একাধিকবার আসা-যাওয়া করেছেন। তার স্ত্রী ও পুত্র এখন স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। আর একমাত্র কন্যা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। এসব বিষয় সামনে রেখেই আমরা এগুচ্ছি। ’
অপরদিকে, কেন্দ্রীয় বিএনপির সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সভাপতি ইলিয়াছ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে তার সঙ্গে সর্বশেষ ফোনে কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। উনি কোথায় আছেন এ সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই নেই। ’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনারা চৌধুরী ১৯৯৯ সাল থেকেই লন্ডনে বসবাস করেন। ছেলে নাইম চৌধুরী জনি বার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করে সেখানেই কর্মরত রয়েছেন। মেয়ে সামিরা তানজিম হারিছ লন্ডনে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। যুক্তরাজ্যে বিলাসবহুল একটি বাড়িরও মালিক হারিছের পরিবার।
উল্লেখ্য, হারিছ চৌধুরীর স্থাবর সম্পত্তির বেশিরভাগই তার ছেলে-মেয়ের নামে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকের একটি মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে হারিছ চৌধুরীর। এছাড়া মানি লন্ডারিং, অবৈধভাবে গাড়ির তেল খরচ, সরকারি বাড়ি অন্যের নামে কেনা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও হাওয়া ভবন দাপিয়ে বেড়ানো এ নেতার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ২৫ জুন, ২০১১