ঈদ ব্যাপারটা মূলত ছোটদের। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা ঈদে আনন্দে উদ্বেলিত হয়।
ঈদ কি শুধুই শিশুদের-শৈশবের? না, ঈদ সবার-আবালবৃদ্ধবনিতার। কিন্তু ঈদের আনন্দ সবটাই আবর্তিত হয় শিশু-কিশোর ও শৈশবকে ঘিরে। এটাই ঈদের প্রধান তাৎপর্য। শিশুদের বাদ দিয়ে কোনো আনন্দ নেই ঈদে, কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা উপভোগ্যও নেই। এটাই ঈদের ধর্মীয় পবিত্রতার প্রারম্ভিক তাৎপর্য। ঈদের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে উঠেছে মানবজাতির ভবিষ্যতের দর্শনের ওপর। ঈদ শিশুদের এবং মানুষকে শিশু বানাবার। ঈদ সবার জন্য জীবনের কেদ-কালিমা পেছনে ফেলে নতুন জীবনে সামনে চলার অঙ্গীকার গ্রহণের। ইদুল ফিতর আসে পুরো এক মাস সিয়াম সাধনার পর। জীবনকে পরিশুদ্ধ, পাপমুক্ত ও শৈশবমুখী করার ঐকান্তিক অনুশীলনের পর ঈদ আসে। আসে নবজন্মের আহ্বান নিয়ে, শিশুর মুখের অনাবিল হাসি নিয়ে।
ঈদের এর পরের তাৎপর্যটি হচ্ছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। নিভৃত সাধনার গৃহে অন্তরে আল্লাহকে অনুভব করার সাধনা করা যায়। রমজানে এমন সাধনার অনুশীলনই করে সাধক-বান্দা। কিন্তু সব সাধনার ল্য সমাজে মানুষের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। মানুষ এ বিশাল পৃথিবীর বিশাল মানবসমাজের অংশ। সিয়াম সাধনা ও ঈদকে অবলম্বন করে মানুষ এ বিশাল মানবসমাজের সুশীল সদস্য হওয়ার চেষ্টা করবে, পরস্পরকে ভালোবাসতে, অনুভব করতে এবং বুকে ছড়িয়ে ধরে আনন্দ করতে অভ্যস্ত হবে। ঈদ আসে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে, মানবতাকে মূর্তরূপে উপলব্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি করতে।
ঈদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাৎপর্য হচ্ছে মানুষকে আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেখানো। মানুষের যত বস্তুগত সম্পদ আছে এ পৃথিবীতে, এর সব কিছুই ভাগ করলে কমে। আনন্দ এমন এক সম্পদ, যা ভাগাভাগি করলে বাড়ে। পৃথিবীতে মানুষ শুধু আনন্দের মধ্যেই ডুবে থাকে না, দুঃখের সাগরেও ভাসে। ঈদ মানুষকে দুঃখ ভাগাভাগি করতে শেখায়, আর দুঃখ ভাগাভাগি করলে তা কমে। আনন্দকে দুঃখের ভেতরে নিয়ে যেতে পারলে দুঃখ কমে, তবে আনন্দ প্রকৃত অর্থে বাড়ে-- সে আনন্দ হচ্ছে দুঃখকে লাঘব করতে পারার আনন্দ। দুঃখকে লাঘব করতে পারার আনন্দের চেয়ে পবিত্র আনন্দ আর নেই।
ঈদ একাধারে উৎসব ও ইবাদত। ইবাদতের অংশটা ধর্মীয় এবং উৎসবটা লোকাচার এমন কিন্তু নয়। ঈদ সবটাই ধর্ম এবং সবটাই মানুষের। ঈদ বিত্তবানকে শেখায়, তার বিত্তবৈভবে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের ন্যায্য হিস্যা রয়েছে। এ হিস্যা কিঞ্চিৎ আদায় করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পালিত হবে অন্তত এক দিনের ঈদ। বঞ্চিতকে উপলব্ধি করার এবং কাছে টেনে নেওয়ার এ ব্যবস্থা প্রতীকী।
ঈদের মধ্য দিয়ে অন্তত প্রতীকীভাবে হলেও সমাজের বিভেদ-বৈষম্যকে অতিক্রম করে এককাতারে দাঁড়ানোর একটা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। জাকাত, সদকা, ফিতরা আজকের যুগে আর সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার প্রধান উপায় নয়, তবু মানুষকে উপলব্ধি করার প্রতীকী শিা হিসেবে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম এবং চিরন্তন।
সমাজের সুখী মানুষরা দুঃখী মানুষদের সামনে দিয়েই চলে এবং কখনো কখনো কাছেও যায়। কিন্তু সাধারণত সব কিছুই করা হয় নিজের বৈভব এবং বঞ্চিতের দীনতা স্পষ্ট করে তোলার জন্য। উৎসবে সমাজের বিত্তবানরা বিত্তহীনদের দীনতার ওপর নিজেদের বৈভবের শিখাই শুধু প্রজ্বলিত করতে পারে। কিন্তু ইবাদতে তা পারে না। তাহলে ইবাদতও আর ইবাদত হিসেবে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছায় না। এখানেই ঈদ ইবাদত, নিছক উৎসব নয়।
আধুনিককালে ঈদ শুধু ইবাদত বা উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ঈদ এখন জীবনধারার ওপর আরো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সম হয়েছে। ঈদ এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সম বাজারের ওপর, বাণিজ্যের ওপর। ঈদ এখন সমাজ, বাজার ও অর্থনীতিকে নানামুখী সুপ্রভাব ও কুপ্রভাবে আন্দোলিত করছে। দুঃখজনকভাবে হলেও বাজারে ঈদের কুপ্রভাবের পরিমাণ অনুল্লেখযোগ্য নয়। তবে ঈদ আমাদের বাজার ও জীবনধারাকে বর্ণাঢ্য করে তুলছে উল্লেখযোগ্য হারে। ঈদুল ফিতর আসে রমজান মাস পার হয়ে শাওয়ালের ১ তারিখে আর বাজারে ঈদের আগমনী ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে অন্তত তিন মাস আগে। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে নানা পণ্য উৎপাদনকারীরা ঈদকে কেন্দ্র করে তাদের পসরা সাজায় বছর ধরে।
ঈদ চিরকালের এবং চির নতুন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মুসলমান সমাজের ধর্মীয় উৎসব। অন্যান্য ধর্মেরও অনুরূপ ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। তবে ঈদের মতো ধর্মীয় উৎসব যা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজে এসেছে-এর সূচনা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বলেই মনে করা হয়। সেদিক থেকে ঈদ সর্বাধিক প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবের আধ্যাত্মিক মূল্য অপরিসীম। মানুষ এ উৎসবের মধ্য দিয়ে পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত নতুন জীবনে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করে। এটাও সৃষ্টিকর্তার দান এবং পরম সৌভাগ্য যে ঈদ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত মানুষকেও শৈশবের আনন্দঘন স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মানুষের স্বর্গ বা স্বর্গীয় আনন্দ জীবনের পরপারের চেয়েও মধুর আনন্দঘন শৈশবের স্মৃতিতে। ঈদ আমাদের ক্ষণিকের জন্য হলেও সে জগতে নিয়ে যেতে পারে। নতুন এ ঈদ কোনো উদাসীন দুর্ভাগার জন্যও মুক্তির বার্তা নিয়ে আসুক।
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬০০, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১০