মানবসম্পদ বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কর্পোরেট আস্ক এর সিইও এবং প্রফেশনাল সিভি রাইটার নিয়াজ আহমেদ
একজন মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে কাকে সার্ভিস দেওয়াটা আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন? মালিক পক্ষকে নাকি কর্মজীবীদের?
তাহসিন জাকারিয়া: একজন মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে আমি প্রতিষ্ঠানকে সার্ভিস দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
দেশীয় এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে আপনি কিভাবে পার্থক্য করবেন? কিভাবে দেশীয় কোম্পানিগুলোতে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ম ও কালচার গড়ে তোলা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
তাহসিন জাকারিয়া: আগে দেখতে হবে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ম ও কালচার একটি দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা ও ধারাবাহিকতায় কতটুকু ভূমিকা রাখছে। বহুজাতিক হলেই যে ভালো হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশীয় অনেক কোম্পানিতেও বহুজাতিক কোম্পানির চেয়ে ভালো কালচার ও কর্মপরিবেশ গড়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে একটি কোম্পানির কালচার এতে চাকরিরত কর্মজীবী ও মালিক পক্ষের সামষ্টিক চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস ও সদিচ্ছার সমষ্টি।
'বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রায় দুই লাখ লোক এদেশে এসে কাজ করছে। জানামতে, ৩০০টির বেশি কোম্পানিতে তারা কাজ করছে এবং প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের বেতন নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের লাখো যুবক বেকার। ' - তাহলে কি আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ নেই?
তাহসিন জাকারিয়া: হ্যাঁ এবং না। এটা নির্ভর করছে আমরা কোন স্তরের কর্মীর কথা বলছি এবং কোন ধরনের কাজগুলোতে বিদেশি কর্মীদের আধিক্য দেখতে পাচ্ছি তার উপর। বিশ্বায়নের এই যুগে অনেক কারনেই একটি কোম্পানি বা একটি রাষ্ট্র তার জব মার্কেট বিদেশি কর্মীদের জন্য খুলে রাখতে বাধ্য হয়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। তবে আমাদের নজর দিতে হবে যাতে আমাদের দেশের কর্মীরাও যথাযথ দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে বাইরের দেশগুলোতে নিজেদের জব পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এছাড়া আমাদের নিজেদের সাবলীলভাবে উপস্থাপনায়ও কিছু ঘাটতি আছে। আমরা কি কাজ করি, সেটা আমাদের সিভিতে সাবলীলভাবে তুলে ধরতে পারি না। এখন অবশ্য দেশের অনেক প্রফেশনাল রাইটাররা এটা নিয়ে কাজ করছে। আমি তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
দেশের বেকার সমস্যার কারন কি? উদ্যোক্তার অভাব, যোগ্যতার অভাব, নাকি চাকরির অভাব?
তাহসিন জাকারিয়া: আমার মনে হয় এত মোটা দাগে এরকম একটি জটিল বিষয়ে আমরা সরাসরি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না। আমরা দক্ষ মানবশক্তির অভাবে এদেশ থেকে যেমন একসময় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলে যেতে দেখেছি, আবার চাকরির অভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের দেশের বাইরে চলে যেতেও দেখেছি। দক্ষ ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক করবে বাজার। বাজারে দক্ষতার কাটতি ও কদর দুটোই আছে, অভাব যা আছে তা হলো সমন্বয়ের। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমাদের চাকরির বাজারের বিশাল গ্যাপ রয়েছে।
একজন লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন দিকে বিশেষ নজর দেন?
তাহসিন জাকারিয়া: একজন মানবসম্পদ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে সেখানকার সমস্যাগুলো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আবার পেয়েছি এমন কিছু সহকর্মী যাদের ছিল অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার মতো তীব্র মানসিকতা। আজকের দিনে প্রত্যেক কর্মীকেই তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তার মত ভাবনা চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমি শুধু কর্মীই খুঁজি না, আমি কর্মীর মাঝে একজন উদ্যোক্তাকেও খুঁজি।
“সুপারিশ ছাড়া চাকরি হয় না”- নতুনদের অনেকেরই এধরনের ধারনা রয়েছে। আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
তাহসিন জাকারিয়া: একজন মানবসম্পদ বিভাগের পরামর্শক হিসেবে যখন আমাদের রিক্রুটমেন্ট, সিলেকশন এবং পে-রোল নিয়ে কাজ করতে হয় তখন আমরা একজন কর্মীর অতীতের অর্জনসমূহ বিশ্লেষণ করি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো সেটার সাথে যুক্ত করে সিদ্ধান্তে উপনীত হই। সেক্ষেত্রে কখনোই কারো সুপারিশকে প্রাধান্য দেই না।
ইর্ন্টাভিউ নেয়ার সময় ক্যান্ডিডেটদের কি কি সমস্যা আপনার চোখে পড়ে?
তাহসিন জাকারিয়া: পারফর্মেন্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং কে পি আই কনসালটেন্ট হিসেবে দেখেছি কোম্পানিতে অনেক মানুষ অসন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করেন। অনেকে আছেন নিজের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে মনযোগী না হয়েই বেতন বৃদ্ধির অজুহাতে কর্মস্থলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেন। এই ধরনের ক্যান্ডিডেট ইন্টার্ভিউ দিতে এসে প্রায়ই ঘাবড়ে যান এবং পূর্বের কোম্পানিগুলোর বাজে অভিজ্ঞতা শেয়ার এর অন্তরালে নিজের দুর্বলতাগুলোকে তুলে ধরেন।
কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বে কিভাবে নিজেকে আমরা প্রস্তুত করতে পারি?
তাহসিন জাকারিয়া: আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সে জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বিভিন্ন সামাজিক ও খন্ডকালীন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর স্বপ্ন দেখা কখনোই বন্ধ করা যাবে না, স্বপ্নটা অর্জন করার জন্য যা করা দরকার (জ্ঞানার্জন, দক্ষতার উন্নয়ন কিংবা অভ্যাসের পরিবর্তন) তা সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই সম্পাদন করতে হবে।
মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার আনন্দ ও চ্যালেঞ্জ কি কি?
তাহসিন জাকারিয়া: মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হল আপনি সরাসরি আপনার সিদ্ধান্ত ও কাজের প্রতিফলন সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের উপরে কি প্রভাব ফেলছে তা দেখতে পাবেন। এইচ আর এর যে পর্যায়েই আপনি চাকরি করেন না কেনো, আপনার কর্ম ও দক্ষতার প্রভাব পড়বে প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ে এবং সর্বোপরি ঐ প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদের উপর। এটি একই সাথে যেমন একটি আনন্দের বিষয়, সেই সাথে চ্যালেঞ্জিংও বটে।
দক্ষ মানবসম্পদ প্রফেশনাল হতে হলে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে?
তাহসিন জাকারিয়া: পেশাগত ও ব্যক্তিগত দু'পর্যায়েই মানব সম্পদ উন্নয়নে আমি কাজ করছি। পেশাগতভাবে জাতিসংঘের একজন কনসালটেন্ট হিসেবে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়নে আমাকে সাপোর্ট দিতে হয়। এছাড়াও আমরা “স্কীলউইজ” থেকে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং ও সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকি। দেশে দক্ষ মানবসম্পদ প্রফেশনাল তৈরি করার নিমিত্তে স্কীলউইজ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এইচ আর এর সর্বোচ্চ প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন এসপিএইচআর-আই (SPHRi) এর এক্সাম প্রিপারেশন কোর্স চালু করেছে। এছাড়াও এইচ আর এর উপরে দক্ষতা বাড়াতে হলে লেবার ল ভালো করে জানতে হবে। এইচ আর এর উপরে ছোটো খাটো ট্রেনিং অথবা শর্ট কোর্স আপনার জ্ঞান পিপাসা আরো বাড়িয়ে দেবে।
আপনার মূল্যবান সময় এবং মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ
তাহসিন জাকারিয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।
নিয়াজ আহমেদ
প্রফেশনাল সিভি রাইটার
সিইও, কর্পোরেট আস্ক
প্রিয় পাঠক, আপনার প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, ক্যারিয়ার বিষয়ক যেকোন প্রশ্নের উত্তর জানতে, আপনার মতামত জানাতে বা লেখা পাঠাতে চাইলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়। বাংলানিউজের সাথেই থাকুন..