সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে ফিরে: সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে রাতেও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দীর্ঘ ২৭ দিন বন্ধ থাকার পর বুধবার (০৭ জানুয়ারি) থেকে শর্ত সাপেক্ষে শ্যালা নদী দিয়ে আবারও পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার।
নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বনবিভাগ, কোস্টগার্ড ও বিআইডব্লিউটিয়ের কর্মকর্তাদের তদারকির কথা থাকলে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেপরোয়াভাবে নৌযান চলাচল করছে। তেলের ক্ষত না শুকাতেই পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে এখন শত শত সার, ক্লিংকার, সিমেন্ট, লবণ, বালু, খাদ্যশস্য, ফ্লাই-অ্যাশসহ বিভিন্ন পণ্যবোঝাই নৌযান বিকট শব্দ করে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে।
রাতে নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকেই তা মানছেন না। এ অপরাধে সিমেন্টের কাঁচামালবাহী (ফ্লাই-অ্যাশ) শ্যামলী-১ নামে একটি কার্গোকে আটক করা হলেও পরে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশবিদ ও স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, এ ভাবে ঘন কুয়াশার মধ্যে বেপরোয়া নৌযান চলাচল করলে আবারও যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এত বড় দুর্ঘটনার পরও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যকে নৌরুট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নেই।
তারা বলছেন, গত ৯ ডিসেম্বর শ্যালা নদীর চাঁদপাই রেঞ্জে তেলের ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। শুধু স্বল্পমেয়াদীই নয়, দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা দাবি করছেন। এমনকী জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলও দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবন ক্ষতির শিকার হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। এ জন্য সুন্দরবনে নৌরুট বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন প্রতিনিধি দল।
সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের খুলনার আহ্বায়ক প্রফেসর আব্দুল মান্নান শুক্রবার সকালে বাংলানিউজকে বলেন, সরকার সব সতর্ক-বার্তা উপেক্ষা করেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে।
তিনি মনে করেন, প্রভাবশালীদের চাপে, সুন্দরবন দিয়ে নৌ-চলাচলের এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা এমিলিয়া ওয়ালসন বলেছিলেন, এই দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্ক-বার্তা। এ থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু সরকার শিক্ষা নিলো না।
তিনি আশঙ্কা করছেন, যেভাবে বেপরোয়াভাবে আবারও নৌযান চলাচল করছে, তাতে যে কোনো সময় আবার দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ও রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করায় এ বনের মধ্য দিয়ে কোনো ভারী নৌযান চলাচল করতে পারে না।
এ ব্যাপারে তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দ্রুত আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।
জয়মনি এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, আবারও বেপরোয়াভাবে রাত এবং দিনে ট্যাঙ্কার ও জাহাজ চলাচল করছে। মাইকে সতর্ক করলেও নৌযানের হর্নের উচ্চ শব্দের কারণে তা শোনা যাচ্ছে না।
তিনি মনে করেন, এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো সময় আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) বেলায়েত হোসেন বাংলানিউজকে জানান, সরকার শ্যালা নদী দিয়ে শুধুমাত্র দিনের বেলায় নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। তবে কুয়াশা বেশি থাকলে দিনের বেলায়ও নৌযান চালানো যাবে না সুন্দরবনের ভেতরের এ নদী দিয়ে।
এছাড়া নৌযানগুলো শ্যালা নদীতে অ্যাঙ্কর (নোঙ্গর) করতে পারবে না ও রাতে চলাচল করবে না।
আর তেলবাহী কোনো জাহাজ বা ট্যাঙ্কার চলাচলেও অনুমতি নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বুধবার মাগরিবের আজানের পর পর ১২টি পণ্যবাহী কার্গো একযোগে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ঢুকে পড়ে। এ সময় টহলরত বনরক্ষীরা তাদের সিগন্যাল দিলে জাহাজগুলো দ্রুত চালাতে শুরু করে।
এ সময় সিমেন্টের কাঁচামালবাহী (ফ্লাই-অ্যাশ) শ্যামলী-১ নামে একটি কার্গোর পিছু ধাওয়া করে শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকা থেকে বনরক্ষীরা কার্গোটিকে আটক করেন।
বৃহস্পতিবার সকালে আটক হওয়া ওই কার্গোটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কার্গোর মালিক পক্ষ হাজির হয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে চলার জন্য ক্ষমা চাইলে কার্গোটি ছেড়ে দেয় কোস্টগার্ড।
তবে বন বিভাগের অভিযোগ অস্বীকার করে কার্গোটির মালিক পক্ষ খুলনা ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমান বলেন, শ্যামলী-১ ভারত থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল নিয়ে মংলা বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে পৌঁছালে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় বনবিভাগ তাদের আটক করে।
সুন্দরবনের শ্যালা নদীর নৌপথ দিয়ে বিকেলের পর নৌযান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা ওই কার্গোর মাস্টারের জানা ছিল না বলে জানান তিনি।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ শুক্রবার সকালে বাংলানিউজকে বলেন, এত বড় এলাকায় জনবল সংকটের কারণে আমরা অনেক কিছুই করতে চাইলেও পারছি না। তারপরও সরকারের নির্দেশনা পালন করছি।
সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে বনবিভাগের হাতে আটক শ্যামলী-১ নামে কার্গো আটক হয়েছে জানলেও বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি তিনি।
তিনি জানান, নৌযানগুলো যাতে শৃঙ্খলা মেনে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে এবং অয়েল ট্যাঙ্কার যাতে সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী কার্গো ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের মালিকরা বার বার পার পেয়ে যান। মংলা সমুদ্রবন্দরের কাছে ডুবে যাওয়া তেলের ট্যাঙ্কারটি থেকে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটালেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫