ইনানী থেকে: দাদুকে জিজ্ঞেস করেন, জুমচাষ না করে বাঁশের জিনিসপত্র, পুঁতির গয়না, তাঁতের কাপড় বুনে যদি আরও ভালো আয় করা সম্ভব হয় তাহলে কেমন হবে? প্রশ্ন শুনলেন তরুণ শলোমন (২৯)। একই প্রশ্ন রাখলেন বছর আটষট্টির ফুংপ্রে ম্রো’র (বাংলায় মুরং) কাছে।
আলাপে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী ক্রিসান, চংদুই, মেনদন ম্রো। অধিকাংশই বাংলা সামান্য বুঝলেও বলতে একেবারে পারেন না। কেউ কেউ তো একেবারেই বোঝেন না। কর্মশালায় অংশ নেওয়া ১৪ জনের ম্রো দলে শলোমনসহ দু-একজন যা একটু বোঝেন তাদেরকে দোভাষীর ভূমিকায় রেখে সব কাজ চলছে। ঢুলুঢুলু চোখে বসে রয়েছে দুই কিশোরী উইপাও ও রুইপাও। দলে তারাই সবচেয়ে কমবয়সী। পাহাড়ে সন্ধ্যার পরপরই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস। এসেছেন পোয়ামুহুরী, মিরিংচর, আমতলী, খেতদিংপাড়া, রুহতন পাড়া, সোনাইছড়ি থেকে সবাই এসেছেন। এখানে অজানা-অচেনা পরিবেশ, দিনভর কাজ- রাতের খাবার খেয়ে বাকিরা রুমে ফিরে গেলেন।
ফিরে আসি জুম চাষে। গবেষকরা বলছেন, দীর্ঘবছরের ঐতিহ্যবাহী এ জুমচাষ এখন আর তেমন ফলপ্রসূ হয়ে উঠছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বাড়ছে। সেই অনুপাতে কমে যাচ্ছে জমির পরিমাণ। আগে মানুষ কম থাকায় জুমচাষের কাট অ্যান্ড বার্ন পদ্ধতি সামলে নিতো বন। কিন্তু এখন সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না। একই জমিতে অতিরিক্ত জুমচাষের ফলে জমিও অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও একই মত দিলেন ফুংপ্রে দাদু। জীবনের দীর্ঘসময় তিনি জুমচাষ করেছেন, এখন বাড়িতে বসে বাঁশের জিনিসপত্র বানান। জানান, আগে পাঁচ হাড়ি বীজে ধান হতো ২শ’ হাড়ি। এক হাড়িতে ১০ কেজি। এখন ৫০ হাড়িও হয় না।
অন্যদিকে, বনবিভাগ অনেক জমি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। বাকি চাষাবাদহীন জমিতে লাগিয়ে দিচ্ছে সেগুন-ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি। ফলে সেখানেও করা যাচ্ছে না জুম চাষ।
আগে জুম চাষ করেই সারাবছরের খোরাক উঠে আসতো বলে মত একসময় ভিডিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মেনদোন ম্রো’র। বলেন, এখন জুম করে সারা বছর চলে না। এ জন্যই অনেকে জুম ছেড়ে ভিন্ন পেশা খুঁজছে। জুম বাদ দিয়ে যাদের বেশি টাকা আছে তারা কলা, ভুট্টা, তিল, তুলার চাষ করছে।
কিন্তু তাতেও ঘুরে-ফিরে নানাভাবে বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি করছে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ কন্সারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ)।
ঐতিহ্যগতভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নানান হস্তশিল্পে পারদর্শী। নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁশের তৈরি নানা জিনিসপত্র, পুঁতির গয়না, তাঁতের কাপড়-কম্বল বানিয়ে থাকেন। এগুলো বেশি বানিয়ে বিক্রি করা যায় না?
এগুলো আমরা বিক্রির জন্য বানাই না, নিজেদের জন্যই বানাই। এখন অনেকে নিজেদের জন্য বানানোই ছেড়ে দিয়েছে, উত্তর দিলেন ক্রিসান ম্রো (২৪)।
ক্রিসান নারী স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে এক সময় কাজ করেছেন। এখন পরিবারকে সময় দিতে হয়। সামান্য জুমচাষ ও চাষাবাদ করেই দেন চলে যায়। নিজে অনেক হাতের কাজ জানেন কিন্তু নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতায় নিজেদের প্রয়োজনেও করে ওঠা হয় না।
কী সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা? ‘এখন আগে মতো আর বাঁশ পাওয়া যায় না। বাঁশ আনতে অনেক গভীর বনে যেতে হয়। সেখান থেকে কেটে আনাটা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। বনবিভাগ ও সাধারণ পাহাড়িরা বাঁশঝাড় কেটে জুম বা অন্যান্য ফসল লাগাচ্ছে। এছাড়া পুঁতির দামও অনেক বেশি। ৪৫০ গ্রাম পুঁতি (স্থানীয় ভাষায় এক পন) ১২শ’ টাকা। আলীকদম শহর ছাড়া কাছাকাছি আর কোথাও পাওয়া যায় না। সাতকানিয়ায় কম দামে পাওয়া গেলেও অনেক দূর হয়ে যায়। ’
জুমচাষ করে চলছে না। বন ধ্বংস হতে হতে একসময় চাষাবাদ যা হচ্ছে তাও আর সম্ভব হবে না। এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীই একসময় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে!
ঠিক এই জায়গাগুলো নিয়েই কাজ করছে সিসিএ টিম। তারা চান, বন-বন্যপ্রাণিও থাকুক আবার সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীও। এক্ষেত্রে উপায়ও গবেষণা করে বের করেছেন তারা- পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পেই টেকসই পেশা তৈরি। সেটিও আরেকটু পরিশীলিতভাবে। এরই অংশ হিসেবে সিসিএ ও বি ক্র্যাফট মিলে ১৩ জন ম্রোকে নিয়ে আয়োজন করেছেন একটি কর্মশালার। পণ্য উৎপাদন থেকে টার্গেট ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুই করবে প্রতিষ্ঠান দু’টি। শুরুতে ০৫-০৭ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী কর্মশালা পরিকল্পনা থাকলেও শেষের দিনটি ম্রোদের সুবিধার কথা ভেবে হচ্ছে না। এজন্য বৃহস্পতিবারই (০৬ অক্টোবর) শেষ হচ্ছে এটি।
কর্মশালার উদ্দেশ্য- কর্ম উৎসাহ ও দক্ষতা বাড়ানো, বনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার বাড়ানো, উদ্ভাবনী দক্ষতাসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
এতো ভারী ভারী কথা বোঝেন না ফুংপ্রে, ক্রিসান, চংদুই, রুইাপাওরা। সচেতনভাবে তারাও চান না বন ধ্বংস হোক। এই বন-পাহাড়েই তাদের বেড়ে ওঠা, ঐতিহ্য ও পরম্পরা। তারা এখানেই খেয়ে-পরে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে চান।
সহজে কর্মশালার উদ্দেশ্য যতোটা পারা যায় বোঝানো হলো তাদের। পাশাপাশি তারাও দু’দিন অংশ নিয়ে নিজেদের মতো বুঝলেন। এ দুই মিলে তারাও বুঝতে পারছেন, জুমচাষে তাদের ভবিষ্যৎ হুমকির দিকে। বনই যদি না থাকে তাহলে তারা থাকবেন কীভাবে। এজন্য নিজেদের প্রিয় হস্তশিল্পকেই টেকসই পেশা করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন তারা।
আয়োজকপক্ষ বলছে, এমন নয় এখনই জুমচাষসহ সব বন্ধ করে দিতে হবে। ধীরে ধীরে তাদের বর্তমান পেশা থেকে হস্তশিল্পসহ অন্যান্য টেকসই পেশার দিকে নিয়ে যেতে হবে। এটি ধারবাহিক ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, এই কর্মশালার মধ্য দিয়ে শুরু হলো।
বাংলাটা ভালোই বলতে পারেন ক্রিসান। বললেন, বসে থাকার চেয়ে এই কাজ অনেক ভালো। অনেকেই কাজ না পেয়ে বসে আছে। এসব করে যদি ভালো উপার্জন হয় তাহলে খুব ভালো হবে। অন্যকাজ করার আর দরকার হবে না।
**প্রজন্মের মধ্যে হস্তশিল্পকে টিকিয়ে রাখা জরুরি
** ঐতিহ্য ও আধুনিকতা বিনিময়ের কর্মশালা
** কক্সবাজারে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কর্মশালা
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৬
এসএনএস/এটি