ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

সংগঠক হিসেবেও সফল জালাল ইউনুস

সাজ্জাদ খান, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
সংগঠক হিসেবেও সফল জালাল ইউনুস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ক্রিকেটার। অবসরের পর কোচ, ম্যানেজার তথা ক্রিকেটীয় কৌশলগত অংশেই যাদের বিচরণ।

অবসরে যাওয়া ক্রিকেটারদের ঠিক এমন কিছু ছবিই গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায় সবার মানসপটে আঁকা আছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। সে তালিকায় আসতে পারে ক্রিকেট ছেড়ে পরবর্তী জীবনে সংগঠক হওয়া। আবার এ পথে এসেও পা হড়কানোর উদাহরণ আছে অনেক। সফলতার বরমাল্য সবাই পাননি।   বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই দ্বৈত ভূমিকার চ্যালেঞ্জিং পথে হেঁটে সাফল্য পাওয়া একজন হলেন, জালাল ইউনুস।

সাবেক ক্রিকেটার এবং বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস আদতে একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক। বর্তমানে বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন।   দীর্ঘদেহী, গতিমান বাঁহাতি পেসার জালাল ইউনুসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৩  সালে ভিক্টোরিয়া ক্লাব দিয়ে। এরপর ধানমন্ডি ক্লাব হয়ে  তখনকার শীর্ষ ক্লাব আবাহনীতে কাটিয়েছেন এক যুগ। ধান্ডমণ্ডির অভিজাতার পাড়ার ক্লাব আবাহনীতে তার খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি ঘটেছে। ১৯৮৯ সালে ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস-বল তুলে রাখার পর ওই ক্লাব থেকেই নিয়েছেন সংগঠকের পাঠ। ১৯৯০ সালে আবাহনীর কোচ ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন। যেখানে এখনও ক্রিকেট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। ক্রিকেটে অন্তঃপ্রাণ জালাল ইউনুসের  খেলোয়াড়ি ও সাংগঠনিক জীবনের আদ্যপান্ত জানতে তার  মুখোমুখি হয়েছিল বাংলানিউজ। প্রথম পর্বে প্রকাশিত হয়েছে তার খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে তার সাংগঠনিক দক্ষতার নানা দিক। সাক্ষাতকার গ্রহনে ছিলেন বাংলানিউজের স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট সাজ্জাদ খান।

  
বাংলানিউজ: ক্রিকেটার জালাল ইউনুস ক্যারিয়ার শেষ করেছেন আবাহনীতে। সংগঠক হিসেবে শুরুটাও এখানে। সংগঠকের ভূমিকায় কীভাবে আসলেন?
 
জালাল ইউনুস: ১৯৮৯ সালে ক্রিকেটে অনিয়মিত হয়ে গেলাম। যখন দেখলাম ইনজুরি আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আস্তে আস্তে ক্রিকেট থেকে সরে আসলাম। ১৯৯০ সালে আবাহনীর টিম ম্যানেজার কাম কোচের দায়িত্ব পেলাম। ওই মৌসুমে একটা সমস্যা হলো। আবাহনীর কিছু বড় প্লেয়ার অন্য ক্লাবে চলে যাওয়ায় টিম দূর্বল হয়ে যায়। এরপর ১৯৯১ সালে জিএম তামিম জিএমসিসিতে চলে যায়। তান্না ভাই তখন ক্রিকেট বিভাগের জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি আমাকে বলেন, আমাদের টিমের যে অবস্থা তাতে আমরা তো রেলিগেশনে চলে যাবো। এতো বড় ক্লাব রেলিগেশনে চলে গেলে এরচেয়ে বদনাম আর কিছুই হতে পারে না।   তিনি বললেন, এটা লুক আফটার করো। তখন আমাদের ক্লাবের টিম ম্যানেজার বুলু ভাই (এম এ আউয়াল চৌধুরী-উইমেন্স উইংয়ের চেয়ারম্যান)। আমি সেক্রেটারি ও কোচের দায়িত্ব পালন শুরু করলাম। এভাবেই সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু।
 
বাংলানিউজ: ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত হলেন কীভাবে?
 
জালাল ইউনুস:
ক্রিকেট বোর্ডে আসার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আবাহনী ক্লাবের অবদান। এতো বড় মাপের একটি ক্লাবে আমি সেক্রেটারি ছিলাম টানা ১১ বছর। ইটস নট ম্যাটার অ্যা জোক। ডেডিকেটলি কাজ করেছি। অর্থনৈতিকভাবে যখন সমস্যায় জর্জরিত ক্লাবটি তখনও আমরা টিমটা চালিয়ে গেছি। ৬ বছর ক্লাব চালানোর পর ১৯৯৬ সালে সাবের ভাই (সাবের হোসেন চৌধুরী) অফার দিলেন বিসিবির অ্যাডহক কমিটির মেম্বার হিসেবে কাজ করার জন্য। ৯৬-৯৭ এ যখন বিসিবিতে নির্বাচন হলো, আমি নির্বাচিত হলাম। তখন প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী। ১৯৯৭ এ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড থেকে ক্রিকেট বোর্ড করা হলো, পরিচালনা পর্ষদ হলো। এরপর আরেকটা নির্বাচন হলো, আমি নির্বাচিত হলাম।   এভাবেই আমার ক্রিকেট বোর্ডে আসা।
 
বাংলানিউজ: সংগঠক হিসেবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট কী ছিল?

জালাল ইউনুস: ১৯৯৮ সালের যুব বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাগামী বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজার করা হয় আমাকে। আমাদের গ্রুপে ছিল ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও নামিবিয়া। গ্রুপ ম্যাচে আমরা ইংল্যান্ডকে হারাই। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাই। রান রেটে পিছিয়ে থাকায় আমরা উঠতে পারিনি। প্লেট পর্বের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাই। প্লেট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী দলকে প্রথমবারের মতো হারানো। ওই সময় ম্যানেজার হওয়ার যে অভিজ্ঞতা, তা আমাকে বুস্টআপ করছিলো। যার জন্য সংগঠক হিসেবে এতোদূর আসা।
 
বাংলানিউজ: বিসিবির মিডিয়া কমিটি সামলাচ্ছেন অনেক বছর ধরে। মিডিয়া কমিটিতে কাজ শুরু করেছেন কবে থেকে?

জালাল ইউনুস: ১৯৯৮ সালে যখন ঢাকায় মিনি বিশ্বকাপ হলো তখন আমাকে সাবের ভাই বললেন, মিডিয়া সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতে পারবো কি-না? ব্রডকাস্টার-সাংবাদিকদের সামলানো কিন্তু খুব কঠিন। আমি বললাম, কেন পারবো না। ওই টুর্নামেন্টে আমি প্রথম মিডিয়া সেক্রেটারি হই ও সফলভাবে ইভেন্টটি শেষ করি।  
 
বাংলানিউজ: মিনি বিশ্বকাপে তো বাংলাদেশের ‘আয়োজক’ পরিচয়ের প্রথম ধাপ ছিলো। সবগুলো বড় দেশ অংশ নেয়। তখন কাজ করাটা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর ছিলো?

জালাল ইউনুস: আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রেসবক্স কেমন করে চলে, একটা মিডিয়া সেন্টার কেমন হয়। এখনকার মতো তো অবস্থা ছিলো না। মিডিয়া সেন্টারে টেলিফোন, ফ্যাক্স এগুলো আনার ব্যবস্থা করা। ’৯৮-এর মিনি বিশ্বকাপে একশ’র বেশি বিদেশি সাংবাদিক এসেছিলেন। কলকাতা, পাকিস্তান থেকেই এসেছিলো ৪৫-৫০ জন। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছিলেন। তখন ‘টেলিগ্রাফ’র একজন রিপোর্টার এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া-ব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখেছিলেন।  

বাংলানিউজ: নতুন অভিজ্ঞতা হলেও নিশ্চয়ই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো?

জালাল ইউনুস: সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ঢুকতাম, বের হতাম রাত ১১টায়। আমি নিজে সাংবাদিকদের জন্য অ্যাক্রিডেশন কার্ড বানাতাম। এখন তো কতো সেট আপ, কতো ম্যানেজার। তখন মিডিয়া সেক্রেটারি হিসেবে বসতাম। সঙ্গে ৩-৪ জন থাকতো। যেমন- ওয়াসিম ভাই। এছাড়া ২-৩ জন কমিটির মেম্বার থাকতো। ওইখানে বসেই অ্যাক্রিডেশন কার্ড বানাতাম, ওইখানেই লেমেনেটিং করতাম। সবকিছুই আমাকে করতে হতো। ফরম ফিল আপ, তা চেক করা, মিডিয়া সেন্টার অর্গানাইজ করা। অনেক দায়িত্ব ছিলো তখন।
 
বাংলানিউজ: ওই অভিজ্ঞতাই কী মিডিয়া কমিটিতে আসার আত্মবিশ্বাসটা যুগিয়েছে?

জালাল ইউনুস: আমি তো ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স নিয়ে পড়েছি। আমার তো মিডিয়া ব্যাকগ্রাউন্ডই ছিলো না। কিন্তু মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করে ততোদিনে ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। মিনি বিশ্বকাপে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক বেশি হেল্প করেছে। বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় সাংবাদিক/স্পোর্টস রাইটারদের সঙ্গে মেলামেশা, কথা বলা; পরবর্তীতে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যানই (২০০১-২০০৩) হয়ে গেলাম। তারপর অ্যাডভাইজারি বোর্ড যখন হলো তখন মিডিয়ার চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিলাম। আবার ২০০৮ সালে এসে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান হলাম। ২০০৮ সালে চয়েজ দেওয়া হলো। আমি বললাম যেহেতু মিডিয়াতে কাজ করেছি, তাছাড়া এখানে আমি কমফোর্ট ফিল করি। তখন বলা হলো, ঠিক আছে মিডিয়া কমিটিতেই কাজ করো।  
 
বাংলানিউজ: ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) চেয়ারম্যান হিসেবেও তো কাজ করেছেন। সেখানে অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

জালাল ইউনুস: ১৯৯৬-৯৭’র দিকে আমি সিসিডিএম সেক্রেটারি ছিলাম। ওই সময় ৫টা কিংবা ৬টা টুর্নামেন্ট চালিয়েছি। লিগ ছাড়াও স্বাধীনতা কাপ, দামাল-ছামাল, শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট হতো। তখন সিসিডিএম’র চেয়ারম্যান ছিলেন তানভীর হায়দার। উনার বাইপাস সার্জারি হওয়ায় আমি সেক্রেটারি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হলাম। এটিও আমার জন্য ভালো একটা অভিজ্ঞতা ছিলো।
 
বাংলানিউজ: শুরুর সময়ে তো তেমন জনবল ছিলো না। এখন তো জনবল বেড়েছে। বোর্ডও পেশাদার কাঠামো পেয়েছে। এ পরিবর্তনটা কিভাবে দেখেন?

জালাল ইউনুস: ক্রিকেট বোর্ডে তো এই সেট আপ ছিলো না। এগুলো তো হয়েছে গত ১০ বছরে। তার আগে চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি এরা মিলেই সব কাজ করতাম। এখন এতগুলো ম্যানেজার চালাচ্ছে। এখনতো স্ট্যাবলিশ, ওয়েল সেটেলড ক্রিকেট বোর্ড।  
 
বাংলানিউজ: ক্রিকেটার, সংগঠক ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে আপনার আরেকটা পরিচয়, ব্যবসায়ী। তারপরও ক্রিকেট বোর্ডে সময় দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট কেমন পাচ্ছেন। তারা খেলাটা কেমন বোঝে?  

জালাল ইউনুস: খেলোয়াড় জীবনে বাবার অনেক সাপোর্ট ছিল। উনি মারা গেছেন। পাকিস্তান আমলে এসপি ছিলেন। আমার যখন দেড় বছর বয়স তখন মাকে হারাই। বাবা কিন্তু আর বিয়ে করেননি। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। আমি সবার ছোট। বাবাই আমাদের পাঁচজনকে আগলে রেখেছেন। বিয়ের পর স্ত্রী, বাচ্চাদের সাপোর্ট পাই। বড় মেয়ে ক্রিকেট খুব ভালো বোঝে। পরিবারের সদস্যরা ক্রিকেট বলতে পাগল।
 
বাংলানিউজ: সবকিছু মিলে ক্রিকেটময় আপনার জীবন। ক্রিকেটের মানে জীবনে কীভাবে খুঁজে পান?

জালাল ইউনুস: আই লাভ ক্রিকেট। ক্রিকেট ইজ মাই ব্লাড। মরার আগ পর্যন্ত আমাকে ক্রিকেট নিয়েই থাকতে হবে। আমি ক্রিকেট বোর্ডে আজকে আছি আগামীতে হয়তো নাও থাকতে পারি। কিন্তু ক্লাব ক্রিকেটে হয়তো জড়িত থাকবো। ক্রিকেট নিয়ে কিছু করতে হবে। হয়তো ছোট্ট একটা টিম নিয়ে কাজ করবো। আমি এখন রায়েরবাজার অ্যাথলেটিক ক্লাবের কাউন্সিলর। সেখানেও মাঝে মাঝে যাই। প্লেয়ারদের সঙ্গে কথা বলি। ক্রিকেট ছাড়া যাবে না।
 
বাংলানিউজ: কম বেশি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের পরিধিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোন ছবিটা দেখতে অপেক্ষা করেন?

জালাল ইউনুস: অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এখন যেখানে; আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সেখানে দেখতে চাই। এর জন্য আগামী দশ বছরে যদি পারি কিছু করতে চাই। আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিন্তু ভেরি ডায়নামিক। ক্রিকেটের ডেভেলপমেন্টের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, করছেন, পজিটিভলি। ওনার কাছ থেকে কখনও ‘না’ শব্দটা পাওয়া যায় না। আজকে একটা ভালো কোচ লাগবে, উনি বলে দিচ্ছেন ওকে নিয়ে আসো।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
এসকে/জেডএস

**গয়না বিক্রি করে ক্লাব চালাতেন কর্মকর্তারা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।