ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

টেস্ট, সাকিব-মোস্তাফিজ এবং ক’টি প্রশ্ন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৮
টেস্ট, সাকিব-মোস্তাফিজ এবং ক’টি প্রশ্ন সাকিব-মোস্তাফিজ

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘ইউ ক্যান লিড অ্যা হর্স টু ওয়াটার, বাট ইউ কা’ন্ট মেক ইট ড্রিংক’। বাংলায় যার অর্থ; ‘তুমি একটি ঘোড়াকে পানির কাছে নিয়ে যেতে পারো, কিন্তু পানি পানে বাধ্য করতে পারো না।’ জাতীয় টেস্ট ক্রিকেটের দশা ও খেলোয়াড়দের মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন শুক্রবার (২০ জুলাই) রাতে সংবাদমাধ্যমের কাছে ‘বোমা ফাটানো’র পর এই প্রবাদটিই সামনে এলো।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের অমন বিপর্যয়-দশার কারণ খণ্ডাতে গিয়ে বিসিবি সভাপতি কিছু স্পষ্ট কথা বলে ফেলেন, যেমন- ‘আমাদের বেশ কিছু সিনিয়র ক্রিকেটার আছে, টেস্ট খেলতে চাইছে না। ’ বোর্ড প্রধান দু’জনের নামও বলে ফেলেন, সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমান।

পাপনের ভাষ্যে, ‘বলে না যে খেলবো না, এড়িয়ে যেতে চায়। ’

অথচ এদের একজন বাংলাদেশের হয়ে খেলেই পেয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমা, যে তকমার কল্যাণে তার ডাক পড়ে আইপিএল, সিপিএল, বিগ ব্যাশ, পিএসএলের মতো কাড়িকাড়ি অর্থের ফ্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্ষুদ্র সংস্করণের ক্রিকেট লিগগুলোতে। আরেকজন অজপাড়া গাঁ থেকে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ পেয়ে হয়ে উঠেতে পেরেছেন বিশ্বসংবাদমাধ্যমের চোখে ‘কাটার মাস্টার’।

বিসিবি সভাপতি এই ক্রিকেটারদের যে ‘অনীহা’ নিয়ে কথা বলেছেন, সেটা নিয়ে মন্তব্যে না গেলেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। যে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে সাকিব-মোস্তাফিজরা বিশ্ব পরিসরে পরিচিত পেয়েছেন, সেই দেশের হয়ে খেলতে কেন তাদের অনিচ্ছা থাকবে- এমন প্রশ্নে যাওয়ার আগে সামনে চলে আসে ব্যক্তিগত খাতা।

গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া দল বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পরপরই ছয় মাস টেস্ট ক্রিকেট থেকে ছুটি চান সাকিব আল হাসান। যদিও বিসিবি তার ছয় মাস মঞ্জুর করেনি। শুধু অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে তাকে ‘অব্যাহতি’র সুযোগ দেয়। তার মতো প্রধান সারির খেলোয়াড়কে এই ‘ছাড়’ দিতে গিয়ে বাংলাদেশের কী দশা হয়েছিল, তা বোধ হয় সবারই মনে আছে। প্রথম টেস্টে প্রোটিয়াদের কাছে ৩৩৩ রানের বিশাল ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় টেস্টের ফল আরও লজ্জার, ইনিংস ও ২৪৪ রানের ব্যবধানে পরাজয়।
 
কয়েক মাস পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরে এলো শ্রীলঙ্কা। সেখানেও দুই টেস্ট সিরিজে এই গেম চেঞ্জারকে পাওয়া যায়নি। তার বাঁ হাতের কনিষ্ঠার চোটের কারণে।

টেস্টে এই দীর্ঘ বিরতির পর ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে গেলেন ‘বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার’। তার নেতৃত্বে যাওয়া বাংলাদেশ দুই টেস্টে কী করলো? প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার মতো চরম লজ্জার রেকর্ড। এর পরের ইনিংসগুলো যে সেই লজ্জা ডেকেছে, তেমনও নয়, বরং ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাটে বাংলাদেশিদের দায়িত্বহীনতা, আনাড়িপনা ও চরম ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। পরের তিন ইনিংসে সংগ্রহ ১৪৪, ১৪৯ ও ১৬৮। ফল প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ২১৯ রানের বিশাল পরাজয়, দ্বিতীয় টেস্টে ১৬৬ রানে হারে গ্লানি।

আর এই ‘কীর্তি’তে তার ‘অবদান’ অনস্বীকার্যই বটে! দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে ৩৩ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ইনিংসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৫৪ রান। বাকি তিন ইনিংসে ৩২, ০, ১২। আর বোলিংয়ে প্রথম টেস্টে ২৭ ওভারে ৭১ রানের বিনিময়ে ২ উইকেট, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২২ ওভার বল করে ৬০ রানের দিয়ে উইকেটশূন্য।
 
দু’টি টেস্টের পরই ভাষ্যকাররা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ নিয়ে কথা বলছিলেন। উইকেটে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে দেখা যাচ্ছিলো না কারও, যেন আউট হলেই ‘বিশ্রাম’ পাওয়া যায়।  

এখানে ব্যাটিংয়ের অন্যতম ভরসা সাকিব আল হাসানের নাম সামনে এসেছিল কি-না, সেটা ঘাঁটার আগেই প্রশ্ন ওঠে, ক্রিকেটে সামর্থ্য বিচারের মূল ক্ষেত্র যখন টেস্ট, তখন কেন দেশের হয়ে ছয় মাস এই খেলা থেকে ‘বিশ্রাম’ চান সাকিব আল হাসান। মাসের পর মাস আইপিএল, সিপিএল, বিগ ব্যাশ, পিএসএল খেলে কি তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে যান? যদি ক্লান্ত হয়ে যান, তবে কেন তাকে এসব লিগে খেলতে দেওয়া?

গুঞ্জন আছে; অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও টেস্ট স্কোয়াড গঠনের সময় স্বশরীরে উপস্থিত থাকেন না সাকিব আল হাসান। তার সঙ্গে মোবাইল ফোন কিংবা স্কাইপে আলোচনা করে দল ঘোষণা হয়। অথচ প্লেয়ারদের চর্মচক্ষে পরখ করে দেখতে হয় তার উপস্থিতি অপরিহার্য কি-না।   
 
সাকিবকে নিয়ে এই গুঞ্জন না খণ্ডাতে গেলেও প্রশ্ন আসে আরেকটি বিষয়ে। গেল দেড় বছর টেস্টে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে নাস্তানাবুদ করেছে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদের বিপক্ষেই শততম টেস্ট জয়ের গৌরব নিয়ে দেশে ফিরেছিল লাল-সবুজের দল। পাপনের ভাষ্যে, সাকিব যদি টেস্ট খেলতে ‘অনীহাই’ দেখান, তবে কেন তার হাতে উঠলো টেস্ট দলের ঝাণ্ডা? কেন মুশফিকুর রহিমকে সরিয়ে তাকে টেস্ট অধিনায়ক করা হলো? যে ফরম্যাটের প্রতি তার ন্যূনতম আগ্রহ নেই, দলের প্রতি যার ন্যূনতম প্রতিশ্রুতি নেই তাকে অধিনায়ক করে বিসিবি কি তাহলে তাকে আনুকূল্য দেখাচ্ছে না? নাকি ‘অনিচ্ছুক’ সাকিবের কাছে জাতীয় দল কোনোভাবে জিম্মি? 

সাকিবের খাতার পাশাপাশি বিসিবি সভাপতি সেদিন রাতে মোস্তাফিজুর রহমানের খাতাটাও ঘেঁটে দিলেন। যিনি বছরের ছয় মাসই ইনজুরিতে থাকেন। এই ইনজুরিটা বরাবরই চমকে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে সবশেষ আইপিএল খেলে এসে তিনি চোটাক্রান্ত হন এবং শেষ মুহূর্তে দলের স্কোয়াড থেকে ছিটকে পড়েন।

এ নিয়ে বিসিবি সভাপতির খেদটা গায়ে লাগারই মতো, ‘মোস্তাফিজ বাইরের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ছে। আর দেশকে সার্ভিস দিতে পারছে না। আমি মনে করি এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। আমাদের বোর্ডে থাকবে। বোর্ডই তার দেখভাল করবে। আবার ওদের জন্য খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলবে না। আবার তাকে আমরা ঠিক করবো। এটা হতে পারে না। আমি তাকেও বলে দিয়েছি, আগামী দুই বছরের মধ্যে তার বাইরে যাওয়া চলবে না। ’
 
এই নিষেধাজ্ঞা মোস্তাফিজের মতো তরুণের কাছে কঠিন মনে হলেও তারও কি ভাবা উচিত নয় যে, ‘সবার আগে দেশ?’ যেটা আগে থেকেই তাকে বারবার বলে আসছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘আইকন’ মাশরাফি বিন মুর্তজা!

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৮ 
এইচএল/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।