ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মশার জ্বালা বড় জ্বালা 

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৩
মশার জ্বালা বড় জ্বালা  প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রাম: ‘ঘরেও মশা বাইরেও মশা। সুযোগ পেলেই হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে।

মশার জ্বালা এখন বড় জ্বালা। এতটা অপ্রতিরোধ্য মশা কয়েলের ধোঁয়াও মানছে না।

কাজীর দেউড়ি মোড়ে এভাবেই উদ্বেগ জানালেন ষাটোর্ধ্ব বেলাল হোসেন। তিনি জানান, দিনে রাতে সমানে মশা আক্রমণ করছে। সন্ধ্যায় একটু বাইরে দাঁড়ান দেখবেন ২০-৫০টা মশা আপনার হাতে, পায়ে বসে গেছে। বেশ কয়েকবার মশা মারতে চসিক ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরুর খবর শুনলেও এখন মশকনিধন কর্মীদের খুব একটা চোখে পড়ে না। একসময় ড্রোন উড়িয়ে আলোচনায়ও এসেছিল চসিক।  

আসকার দীঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা কামরুন নাহার জানান, ঘরে মশার কয়েল জ্বালালে, স্প্রে দিলে মানুষের চোখ জ্বালা করে, বৃদ্ধ ও শিশুরা শ্বাসকষ্টে ভোগে, গলা বিষাক্ত হয়ে যায় কিন্তু মশা মরছে না। লুকিয়ে থাকে কিংবা ঘুমিয়ে থাকে! অথবা বাইরে বের হয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকে পড়ে। মশারির ভেতর মোটামুটি নিরাপদ হলেও যেই বের হবো অমনি ঘিরে ধরে মশা। আত্মীয় স্বজন, পরিচিতজনদের অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবরে চিন্তিত।  

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩০, নারী ৩১  ও শিশু ৩৫ জন। মোট আক্রান্ত ১৩ হাজার ৩৯২ জন। এর মধ্যে নগরের ৯ হাজার ৩২৮ জন।  

সূত্র জানায়, মশার মধ্যে কিছুটা অভিজাত শ্রেণির এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী। পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে এ প্রজাতি। কিন্তু নোংরা পানিতে বংশবৃদ্ধিতে দক্ষ কিউলেক্স মশাও বাড়ছে। নগরের ছয়টি এলাকা কোতোয়ালী, বাকলিয়া, বায়েজিদ, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকায় মশাবাহিত রোগাক্রান্তের সংখ্যা বেশি। গত ৭-১৩ নভেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৪১ ওয়ার্ডে মশা নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। প্রতিদিন ৬টি দল কাজ করেছে ৬টি ওয়ার্ডে। এ জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে পরে জানানো হবে।  

অ্যাসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের ৬টি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি উঠে এসেছে ডেঙ্গুবিষয়ক নানা তথ্য।  

গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করেননি এমন ডেঙ্গু রোগী চট্টগ্রামের ৪৫ শতাংশ। রোগীদের মধ্যে দেখা গেছে সচেতনতার অভাব। চট্টগ্রামের ২০ ভাগ মানুষ এখনো জানেন না ডেঙ্গুর মূল কারণ মশা। জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গু মশার বিস্তার বাড়ে সেই তথ্যও ১৫ শতাংশ মানুষ জানে না। ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৪০ শতাংশ মশারি ব্যবহার করতেন না।  

অ্যাসপেরিয়া হেলথ কেয়ারের পরিচালক এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. আবদুর রব, প্রধান গবেষক চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. এম এ সাত্তার, প্রকল্পের সহ-পরিচালক হিসেবে ছিলেন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দীন চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হসপিটালের ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, সহ গবেষক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োটেকনোলজী বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান। এছাড়াও সহ গবেষক হিসেবে ছিলেন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগের ডা. মারুফুল কাদের, মেডিসিন বিভাগের ডা. নূর মোহাম্মদ ও ডা. আব্দুল হামিদ সাগর, বিআইটিআইডির ল্যাব ইনচার্জ ডা. জাকির হোসেন, ফটিকছড়ি হেলথ কমপ্লেক্স এর ডা. ইমরুল কায়সার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক মহব্বত হোসেন ও আফরোজা আক্তার তন্বী, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডা. তারেকুল মজিদ।  

ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু দুটোই কাম্য নয়। কিন্তু গবেষণা রিপোর্ট বলছে, চট্টগ্রামে সচেতনতা তৈরি করা যায়নি। এটাও সত্য চসিক মশা মারার অভিযান নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি। যে অভিযানের কথা শুনেছি সেগুলো মিডিয়াকে দেখানোর জন্য হয়তো। বাস্তবে নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকলে, ছাদবাগানে পানি জমে থাকলে, ছাদে পানির ট্যাংকে মশার প্রজনন ক্ষেত্র আছে কিনা তদারকি অভিযানও হাতে গোনা। নালা নর্দমাগুলো অপরিচ্ছন্ন। এর জন্য শুধু নগরবাসীকে দোষারোপ করলে হবে না। এক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি কঠোর হস্তে আইনের প্রয়োগ দরকার।  

চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের ওপর পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে ৪০ শতাংশ রোগী মশারি ব্যবহার করতেন না, ৪৫ শতাংশ রোগী পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করেননি। এর অর্থ হচ্ছে অসেচতনতা। আশার কথা হচ্ছে গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ৭৬ জন। যা শতাধিক ছিল আগে। ২০২১ সাল থেকে প্রতি মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল। শুধু ২০২২ সালের মে মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল না চট্টগ্রামে। এর মানে হচ্ছে সারা বছর মশার ওষুধ ছিটাতে হবে।  

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন প্রায় সাড়ে তিনশ স্প্রে ম্যান কাজ করছে। প্রতি ওয়ার্ডে ৪-৫ জন। এ ছাড়া পার্ক, কারাগার, হাসপাতালসহ ১০টি বিশেষ স্পটে মশক নিধনে কাজ চলছে নিয়মিত। আমাদের অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড ওষুধ মজুদ আছে তাতে আড়াই মাস চলবে। রুটিন কাজ হিসেবে মশার ওষুধ ছিটানো অব্যাহত রয়েছে।  

তিনি জানান, নানা কারণে মশার প্রজনন ক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। ভূমির অবকাঠামোগত পরিবর্তন এর মধ্যে অন্যতম। যেখানে আগে জলাভূমি ছিল সেখানে এখন ভিটি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে। তাই নিয়মিত জরিপ, গবেষণাও চালাতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৩
এআর/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।