ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চোখের জলে খুঁজে ফিরি প্রিয় ভাইকে

সোহেল সরওয়ার, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪
চোখের জলে খুঁজে ফিরি প্রিয় ভাইকে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Sohel_Sorwar১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। বয়স তখন ৭ কি ৮ বছর।

বেড়ে উঠছি চট্টগ্রাম শহরে। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের বড়ঘোনা গ্রামে।
তেমনি এক অনুষ্ঠানে সেদিন বাবা-মা’র সঙ্গে গিয়েছিলাম বাঁশখালী। সঙ্গে ছোট তিন ভাই।

দিনটি অন্য দশটি দিনের চেয়ে আলাদা হওয়ার কথা ছিল। ইট পাথরের জঞ্জাল ছেড়ে গ্রামের মেঠোপথে বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে মেতেছিলাম তিন ভাই। ভাইয়ের হাতে হাত ধরে এটাই যে আমাদের শেষ মিলন তা জানা ছিলনা তখনও। ভয়াল সেই রাত কেড়ে নিয়েছিল আমার দু’ভাইকে। এক ভাইয়ের লাশ পেলেও আরেক ভাইকে গত ২৩ বছরেও খুঁজে পাইনি। মন বলে, আমার ভাই হয়ত বেঁচে আছে। হয়ত সাগরে ভেসে এমন কোন দূরদেশে চলে গেছে, সে আর ফিরতে পারছেনা। চোখের জল নিয়ে ২৩ বছর ধরে হারানো ভাইকে খুঁজে ফিরছি আমি, আমার হতভাগিনী মা, আমার পিতা।

বাড়ির মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল উপলক্ষে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামে যাওয়া। সঙ্গে আমার ছোট ভাই রাসেল, সুমন ও সাহেদ। তাদের বয়স যথাক্রমে ৫,৩ ও ১ বৎসর। ২৯ এপ্রিল বিকালে বাড়ির পাশে মাদ্রাসার মাহফিলকে ঘিরে বসা মেলায় গিয়ে খুব মজা করেছি। মাহফিল উপলক্ষ হলেও গ্রামের সবার কাছে মেলায় প্রধান আকর্ষণ। ওইদিন সন্ধ্যা থেকেই মাইকে ১০নং মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষগুলো সেই ঘোষণায় তেমন কান দিল না।

বিকেল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে মাহফিল ও মেলা কোনটায় তেমন জমে উঠেনি। সেদিন ছোট ভাইদের নিয়ে চড়েছিলাম নাগরদোলায়। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়তে থাকায় আমরা মন খরাপ করে বাড়ির পথ ধরি। রাতের খাবার শেষে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। তখনই শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। বাড়ির কাছেই বঙ্গোপসাগর। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টির গতিবেগ। হঠাৎ প্রচন্ড এক দমকায় আমাদের ঘরের দরজা ভেঙ্গে পড়ল। ঘরের সবার অলক্ষ্যেই পানি ঢুকে পড়লো ঘরে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে পানি।

মা-বাবা যখন আমাদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয় তখন পানি আমার গলা পর্যন্ত। চারিদিকে মানুষ আর পশু-পাখির বেঁচে থাকার হৃদয় বিদারক আর্তনাদ। হঠাৎ প্রচন্ড এক ঢেউয়ের ধাক্কায় আমার বাবার হাত থেকে ছুটে যায় আমার ছোট ভাই সুমন। বাবাও আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। আমরাও অন্যদিকে ভেসে যাই।

আমার মায়ের দু’হাতে দু’ভাই। এক হাতে আমি। অন্য হাতে রাসেল। মুখে শার্ট কামড়ে ধরে রেখেছেন এক বছরের ছোট ভাই সাহেদকে। সমুদ্রের পাহাড় সমান ঢেউয়ের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে সারারাত পানিতে ভাসতে থাকি। সেদিন দেখেছিলাম জঠরের ধনকে আঁকড়ে রাখার সে কি আকুতি মায়ের। কিন্তু তিনি পারেন নি। এক বছর বয়সী ছোট ভাই মায়ের মুখে কামড়ে থাকা অবস্থায় মারা গেল। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না।  

ভোর হওয়ার আগ মুহূর্ত থেকে ঝড়ের তান্ডব কমতে শুরু করল। সকালে যখন পানি নেমে গেল ছোট ভাইয়ের নিস্তেজ দেহ দেখে মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখনি বুঝতে পারলাম আমার ছোট ভাইকে হারিয়েছি। আমার দেবতুল্য ছোট ভাইটির মৃত দেহ দেখেও কাঁদতে পারলাম না। সারারাত ঝড় ও  ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চোখের পানিটুকুও যেন শুকিয়ে গেল। তখনো বুঝতে পারিনি আমাদের জন্য আরো যন্ত্রণা অপেক্ষা করে আছে।

কিছুক্ষণ পর বাবাকে পেলাম। তখন তিনি পাগল প্রায়। কাঁদছেন এবং এদিক ওদিক কি যেন খুজঁছেন। চারিদিকে লাশ আর লাশ। পথে-ঘাটে, পুকুর, খালে সব জায়গায় হাজার হাজার মানুষের লাশ পড়ে আছে। পশু-পাখি মাছতো আছেই। সমস্ত গ্রাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এসবের মাঝেই বাবা কি যেন খুঁজছেন। যখনি মা ছোট ভাই সুমনের কথা জানতে চাইলেন তখনি বাবার বুকফাটা আর্তনাদ। রাতে বাবার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার পর সুমনকে আর পাওয়া যায়নি। দু’সন্তানকে হারিয়ে মা উন্মাদ প্রায়। আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আমার ছোট ভাইটির কোনো খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজনরা কত জায়গায় খোঁজ করেছে। কিন্তু না সে ফিরে আসেনি। ভয়াল সে রাতের পর পার হয়েছে ২৩ বছর। অবুঝ মায়ের মন এখনো আশা করে আছে তার ছেলে হয়তো বেঁছে আছে! ফিরে আসবে একদিন মায়ের বুকে। আমার দুই ভাইকে কেড়ে নেওয়া সেই রাক্ষুসে ২৯ এপ্রিলকে ভুলি কি করে!

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad