ঢাকা, শনিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কর্মচারীদের বিক্ষোভে উত্তাল ওয়াসা, চার ঘণ্টার ঘেরাও

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪
কর্মচারীদের বিক্ষোভে উত্তাল ওয়াসা, চার ঘণ্টার ঘেরাও ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ব্যাংক স্লিপ জাল করে প্রায় ১৩ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে ১১ জনকে সাময়িক বহিষ্কারের পর কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।

রোববার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে প্রায় চার ঘণ্টা ওয়াসা ভবন ঘেরাও করে রাখে চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন।

পরে এ ব্যাপারে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আশ্বাস পেয়ে তারা ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।

কর্মসূচি চলাকালে জলবাহীসহ ওয়াসার সকল প্রকারের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।


গত নয় মাস ধরে ওয়াসার ১৫টি ভাউচারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরুরি পানি বিক্রির টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলায় গত বৃহষ্পতিবার ওয়াসার একজন সহকারী প্রকৌশলী, এক উপ-সহকারী প্রকৌশলী, এক ওভারশিয়ার এবং ভাউচারের চার চালক ও চার সহকারীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ওয়াসার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকির অভাবে ব্যাংক স্লিপ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এসব উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের দোষ ঢাকতে সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে আট শ্রমিকসহ ১১ জনকে বহিষ্কার করেছে।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, স্বাক্ষর ও সিল নকল করে ওয়াসার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ঘটিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তের ওপর ভিত্তি করে ১১ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এ বিষয়ে শীগগিরই আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জালিয়াত চক্রের সকল সদস্যকে চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

“ইউনিয়ন তাদের মতো করে কথা বলবে। তারা কী কর্মসূচি দিচ্ছে ওপর ভিত্তি করে কোন দুর্নীতিবাজ পার পাবে না। কারো প্রতি আক্রোশ থেকে এ বহিষ্কারাদেশ হয়নি। অধিকতর তদন্তে কেউ নিরাপরাধ হলে তাকে যেমন ছাড় দেওয়া হবে, এর বাইরে কেউ থাকলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। ” বলেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল আটটার দিকে ওয়াসার মূল ফটকে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকদের বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন। এসময় তাদের কর্মসূচির কারণে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কোন কর্মকর্তাকে বহনকারী গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।

অন্যদিকে, জলবাহী যানবাহনের চালকরাও কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ায় ভাউচারের মাধ্যমে পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল।

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে কর্মচারী মূল ফটক থেকে সরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষ ঘেরাও করে অবস্থান নেয় শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন। এসময় সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশও করে তারা।

সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি মো. সালাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ওয়াসার চিহ্নিত কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজেদের লুটপাট ঢাকতে কর্মচারীদের উপর নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। তারাই ওভারটাইমের টাকা দিতে গড়িমসি করে, ২৮ বছর ধরে চাকরিরত কর্মচারীদের পদোন্নতি না দিয়ে নতুন পদায়নের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোচাচ্ছেন।


এসময় ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পেও কর্মকর্তারা দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছে অভিযোগ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।

সমাবেশে মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি বখতেয়ার উদ্দিন খান, শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরি সভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সমাবেশ শেষে সকাল পৌনে ১২টার দিকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাত করে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন শ্রমিক নেতারা। এসময় শ্রমিকদের বহিষ্কারে শ্রম আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ করে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেন।

ব্যবস্থাপনা  পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ এসময় শ্রমিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, চার দিনের তদন্তে আত্মসাতের নমুনা বিশ্লেষণ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এটা কোন শাস্তি নয়, কেবল নিজেদের কাজ থেকে তাদেরকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

“সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েই এ পদক্ষেপ নিয়েছি। শ্রমিকদের প্রতিনিধি নিয়েই নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারা প্রকাশ্যে তদন্ত করবে। কেউ নির্দোষ হলে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। ”

ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে বেলা ১২টার দিকে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম নিজেদের কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এক সপ্তাহ’র আল্টিমেটাম দিয়েছি। এর মধ্যে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আমরা লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করব।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ জানান, ব্যাংক স্লিপ জালিয়াতির ঘটনাটি সম্ভবত প্রায় এক বছর ধরেই হয়েছে। অতীতের রেকর্ড দেখে এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হবে।

“শ্রমিক নেতাদের পাশাপাশি ওয়াসার একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন সিনিয়র অডিট অফিসার এবং একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে নতুন তদন্ত কমিটি গঠিত হবে। তাদেরকে তদন্তের জন্য এক মাস সময় দেওয়া হবে। ”

নগরীতে ভয়াবহ পানি সংকটের কারণে ওয়াসার ১৫টি ভাউচারের দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭৫ গাড়ি পানি বিক্রি হয়ে থাকে। ওয়াসার নিয়মানুযায়ী ভাউচারের পানির জন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি রিকুইজিশন ফরম পূরণ করতে হয়, যেখানে একজন ওভারশিয়ার, একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলী স্বাক্ষর করেন।

স্বাক্ষরিত এ রিকুইজিশন ফরম নিয়ে গ্রাহককে জনতা ব্যাংকের ওয়াসা শাখার নির্ধারিত হিসাবে জমা দিতে হয়। ব্যাংক স্লিপ দেখে একজন ওভারশিয়ার বিতরণের রশিদ দেন। এ রশিদের একটি নমুনা গ্রাহক এবং একটি ভাউচারের চালকের কাছে দেয়া হয়। চালক রশিদ অনুযায়ী পানি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেন।

ওয়াসা কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকদের বেশীরভাগই এ প্রক্রিয়ায় ওয়াসা কর্মকর্তা, চালক ও সহকারীদের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। এই সুযোগে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে জালিয়াতি করে টাকা আত্মসাত করে আসছে।

জালিয়াতির ক্ষেত্রে চক্রটি সই ও স্ট্যাম্প জাল করে ভূয়া ব্যাংক স্লিপ গ্রাহকদের ইস্যু করে পানি সরবরাহ করতো। গ্রাহকদের টাকা ওয়াসার হিসাবের বদলে যেত নিজেদের পকেটে।

তবে ওয়াসার বিতরণ রশিদটি জাল না হওয়ায় সেখানে বিতরণকৃত পানির রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। যার মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টি উঠে আসে।

এ দুর্নীতির ঘটনায় সাময়িক বহিষ্কৃতরা হলেন, ওয়াসার ওয়াটার ওয়ার্ক্স এর সহকারী প্রকৌশলী আশিক মাহমুদ চৌধুরী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম, ওভারশিয়ার আবদুর রহিম, চালক আলতাব আলী, মো. আবদুর রব, মো. শাহ জামাল, আমানত খাঁন এবং সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. ইউছুফ, মো. শাহাদাৎ।

এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর ওয়াসার লাইন স্থাপনের টাকা, গভীর নলকূপের লাইসেন্স ফি এবং নবায়ন ফিসহ বিভিন্ন খাতে জমা দেয়ার টাকা নিয়েও এ ধরণের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।