ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

নতুন প্রজন্ম সফলভাবে এগিয়ে যাবে

এস.বি.টুপসি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪
নতুন প্রজন্ম সফলভাবে এগিয়ে যাবে বেগম মুশতারী শফি

চট্টগ্রাম: ইতিহাসের পাতায় আরও একটি বিজয় দিবস সামনে।   স্বাধীনতার ৪৪ বছরে সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণে শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফির রয়েছে নতুন প্রজন্মকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন।



নতুন প্রজন্মকে নিয়ে স্বপ্নের কথা এ প্রবীণ নেত্রী ব্যক্ত করেন এভাবে, ‘এ প্রজন্মই পারবে বলে আমার বিশ্বাস। এ প্রজন্মের মধ্যে যে জাগরণ আছে তা খুবই আশাব্যঞ্জক।
  সেই প্রেরণায় সমস্ত প্রজন্ম এগিয়ে আসুক দেশ গড়ার কাজে। পড়ালেখার পাশাপাশি দেশপ্রেমিকের দৃষ্টিতে কাজ করে যাক। ’

বেগম মুশতারী শফি শহীদজায়া, শহীদভগ্নি হিসেবেই বেশি পরিচিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের জ্বলন্ত সাক্ষী তিনি।   স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠকও।   ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল বাড়িতে অস্ত্র রাখার দায়ে তাঁর স্বামী ও একমাত্র ভাইকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। তবু ভেঙে পড়েননি।   যুদ্ধকালীন আগরতলার শরণার্থী শিবিরে নিজ হাতে সেবা করেছেন পীড়িত মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ গড়ার কাজে।   আজও তাঁর সেই অদম্য স্পৃহা এতটুকু কমেনি।

স্বাধীনতার মাসে চট্টগ্রামের সর্বাগ্রে শ্রদ্ধাভাজন, নারী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেত্রী, লেখক, শব্দসৈনিক এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজন।

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুরুটা হয়েছিল এনায়েত বাজারের বাটালী রোডের মুশতারী লজ থেকে’ এভাবেই ৭১’র মার্চ মাস ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বেগম মুশতারী শফি।

‘২৬ মার্চ রেলওয়ের অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে বাঙালী ছেলেরা।   তখন বাসায় ছিল আমার স্বামী ডা. শফি ও বেলাল মোহাম্মদ।   বেলাল মোহাম্মদ প্রস্তাব দিলেন এ অস্থির সময়ে হাত গুটিয়ে না থেকে রেডিওকে কাজে লাগাই।

এরপর বেলাল ভাই চলে গেলেন মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে।   আবুল কাসেম সন্দীপ ও আবদুল্লাহ ফারুক হেঁটে রওনা দিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের দিকে।   যাওয়ার সময় বেলাল ভাই বলে গেলেন, ভাবী তুমি যেওনা। আকাশবাণী, ভয়েজ অব আমেরিকা, বিবিসি লন্ডন যেখান থেকেই পার খবর শুনে লিখে রাখ।

সন্ধ্যা ৭টা ৪০মিনিটে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে দুইবার প্রথম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শোনা যায়।   এভাবেই গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ’

তিনি বলেন, একাত্তরের শুরু থেকেই চট্টগ্রাম ছিল আন্দোলন সংগ্রামে উত্তাল। আমার স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি ছিলেন ডেন্টাল সার্জন। মার্চ মাসের শুরুতে তার রোগী আসা কমে গেল। যারা আসতো তাদের খুব গোপনে বিনা পয়সায় সেবা দিতেন।

শহীদজায়া বলেন, এ বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি।   স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০ জন কর্মীর ৫জনই ছিলেন এ বাড়িতে।   ফটিকছড়ি কলেজের আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, কাজী হাবিব, আমার ছোট ভাই এহসানের বন্ধু জালাল, এয়ার মাহমুদ, পাকিস্তান রেডিওর ডিজিএম জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মা-স্ত্রী-ছোটভাই সহ প্রায় ৫০ জনের মত মানুষ এ বাড়িতেই মাটিতে বিছানা পেতে থাকতাম।   সেসময় আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেকের সঙ্গেও যোগাযোগ হত প্রায়সময়।

২৭মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন আসেন ডা. শফীর কাছে।   সাথে আনেন দুই ট্রাক বোঝাই রেলওয়ের লুঠ করা অস্ত্র।   অস্ত্রগুলো রাখা হয় বাড়ির দোতলায়।   সই দেন মুশতারী শফি নিজেই।

৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।   সকালে তাদের বাড়িতে হানা দেয় পাকিস্তানী সেনারা।   সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে উদ্ধার করে বাক্স বোঝাই অস্ত্র।   বেগম মুশতারী শফির স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র ভাই এহসানকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়।   বেগম মুশতারী শফিকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু এক পাকিস্তানী সেনা তাকে ছেড়ে দেন।

উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তিনি বলেন, সে সময় ছিল পূর্ণিমা রাত।   লোডশেডিংয়ের কারণে ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট সব অন্ধকার।   বাচ্চারা কাঁদলে মুখ চেপে ধরি।   পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।   হঠাৎ এক কালো মেঘ এসে আকাশ অন্ধকার করে দিল।   শুরু হল বৃষ্টি।   রাস্তায় পাহারারত পাকসৈন্যরা তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে।   এসময় সুযোগ বুঝে একপেচে শাড়ি জড়িয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ি।   হেঁটে হেঁটে সোজা মিরসরাই।   মে মাসে পায়ে হেঁটে যাই ভারতের আগরতলায়।

দেশত্যাগের পরের সংগ্রামের কথা স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মতিয়া চৌধুরীসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দেখা হল সেখানে। আগরতলায় শরণার্থী শিবিরে দু’মাস কাজ করি। আগরতলার জিভি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া, রোগীদের রিলিফের গুঁড়ো দুধ দেওয়া, ওষুধ দেওয়াসহ অনেক কাজ করি। ’

‘প্রবাসী সরকার টিকেট দেওয়ার পর কলকাতায় মুজিবনগরে যাই।   সেখানে গিয়ে বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুকসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০জনের মধ্যে ৫জনের সঙ্গে দেখা হয়।   তারা সহ কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে  কাজ শুরু করি।   পরে আকাশবাণীতে ছদ্মনাম দিয়ে অনুষ্ঠান করি।

বিজয়ের পর দেশে ফিরে কিভাবে জীবনসংগ্রাম শুরু করলেন? এ প্রশ্নে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি আমি চট্টগ্রাম আসি। এনায়েত বাজারের এ বাড়িটা তখন দখল হয়ে ছিল।   সালাউদ্দিন কাদেরের এক সহযোগী, নাম মনে করতে পারছিনা, সে এই বাড়িটা দখলে রেখেছিল।   আশেপাশের পরিচিতরা অনেকে তখন নেই।

শোক সামলে দেশ স্বাধীনের প্রেরণা বুকে নিয়ে দুর্বিষহ সময়েও হাল ছাড়েননি বেগম শফি।   যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নেমে পড়েন দেশ গড়ার কাজে।   তিনি বলেন, সম্পূর্ণ একলা হাতে আমি সংসার আগলে ধরি।   রেডিওতে চাকরী নিয়ে আমার সাত সন্তানকে মানুষ করতে লাগলাম।   সন্তান, চাকরী, সংসার সব সামলে দিনের শেষে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশে, মিছিলে যোগ দিতাম।   রাতে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে বই লেখার কাজ করতাম।

সেসময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো নারীদের নিয়ে লেখেন ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’ নামের বইটি।   তিনি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় গিয়ে শোকার্ত
মানুষের কাছে নিজেকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতাম।   আমার স্বামী, একমাত্র ভাই মারা গেছে।   আমার জীবনযুদ্ধ লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সবার শোক সামলানোর চেষ্টা করতাম।

যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, চারপাশ দেখতাম আর শিউরে উঠতাম। লালখানবাজার এলাকা পুরোটা পুরুষশূণ্য ছিল।   জায়গায় জায়গায় লাশ পড়ে থাকতো।   সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা লাশ তুলে নিয়ে গণকবর দিত।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে সরকারের সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানিয়ে বেগম মুশতারী শফি বলেন, এটা অত্যন্ত আশার কথা আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বন্দী করে বিচারের আওতায় এনেছে।   কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘৃণ্য রাজাকারদের ফাঁসির আদেশ দিয়ে বিচার কাজ শেষ করতে হবে।

তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে, আমরা ছোট দেশ হয়েও সব অন্যায়ের বিচার করতে পারি।   আমি মৃত্যুর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চাই।   সাধারণ জনগণের মতো আমিও অপেক্ষা করছি এ বিচারকার্য শেষ হওয়ার। ’

জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরা সরাসরি যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি করা জামায়াত ইসলামী নিষিদ্ধ হলে পরে বিভিন্ন নামে বের করা তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোও নিষিদ্ধ হবে।  

বর্তমানে বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকলেও তার কর্মোদ্যম এতটুকু কমেনি। এখনও ছুটে যান গণজাগরণ মঞ্চে-সভায়-সমিতিতে।   তিনি বলেন, ‘বয়সের কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এখনও আমার মধ্যে স্পিরিট আছে। ’

একসময় বান্ধবী সংঘ মহিলা পরিষদ নিয়ে ব্যাপক নারী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন প্রবীণ এ নারী নেত্রী।   সংগঠন থেকে বের হত বান্ধবী পত্রিকা।   গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার নারী সেসময় তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতার আন্দোলন সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল।

নতুন প্রজন্মের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে আমার অনুরোধ তোমরা মানুষ হও, দেশকে ভালবাসো, তোমাদের চেতনা দিয়ে জাতিকে গড়ে তোল।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।