ঢাকা, শনিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মুঠোফোনে পরিকল্পনা, অস্ত্র-বোমা আসে ঢাকা থেকে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪
মুঠোফোনে পরিকল্পনা, অস্ত্র-বোমা আসে ঢাকা থেকে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: নগরীতে স্বর্ণের দোকানে ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতির পরিকল্পনা হয়েছে মুঠোফোনে। আন্ত:জেলা ডাকাত দলের দু’টি গ্রুপ যৌথভাবে এ ডাকাতি সংঘটিত করেছে।

এর মধ্যে একটি গ্রুপ হচ্ছে গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাত ইমতিয়াজ বাবুলের নেতৃত্বাধীন। আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছে হাসান নামের আরেক আন্ত:জেলা ডাকাত।


গ্রেপ্তার হওয়া ইমতিয়াজ বাবুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাকে আরও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে পাহাড়তলী থানার অস্ত্র মামলায় চারদিনের রিমাণ্ডে নিয়েছে পুলিশ।

বাবুলকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে দিনেদুপুরে ডাকাতির একসময়ে হোতা ইমতিয়াজ বাবুলের মুখোশও এতদিন পর নগর পুলিশের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ডাকাতির সঙ্গে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বাইরের দুর্বৃত্তরা জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি। মূলত ইমতিয়াজ বাবুলই ডাকাতির বিষয়ে সার্বিক পরিকল্পনা করেছে। তারপর তার গ্রুপের লোকজন মিলে সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে।

তিনি বলেন, ইমতিয়াজ বাবুল চট্টগ্রামে আরও বড় বড় ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু কখনও ধরা না পড়ায় কোতয়ালি থানা থেকে মাত্র দু’শ গজের মধ্যে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির দু:সাহসিক পরিকল্পনা করেছিল।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইমতিয়াজ বাবুল জানিয়েছে, বাবুল ও হাসান মিলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। হাসান ঢাকায় থাকে। বাবুল চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব ফয়’জলেক এলাকায় বাসা ভাড়া করে সেখানে থাকে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, ১১ জন ডাকাতিতে অংশ নেবে। মাইক্রোবাসের চালক গাড়িতেই থাকবে।

বাবুল চারদিন আগে তার গ্রুপের আরও ছয়জনকে ফয়’জলেক এলাকায় জড়ো করে। তাদের মধ্যে তিনজনকে চট্টগ্রামের বাইরের জেলা থেকে আনা হয়। আর হাসানের নেতৃত্বে তিনজন মাইক্রোবাসে করে দু’দিন আগে আসে ঢাকা থেকে। ইমতিয়াজ বাবুলের দাবি, হাসান মাইক্রোবাসে করে আসার সময় অস্ত্র ও বোমাগুলো নিয়ে এসেছে।

পরিকল্পনা ‍অনুযায়ী তারা মাইক্রোবাস নিয়ে শনিবার সকালে জিপিও এলাকায় যায়। সেখানে মাইক্রোবাস কোথায় রাখা হবে, তারা কয়জন দোকানের ভেতরে যাবে, কয়জন বাইরে থাকবে এসব বিষয় রেকি করে ঠিক করে। এরপর তারা পায়ে হেঁটে পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে ডাকাতি শেষে পালিয়ে যাবার রুট ঠিক করে।

কোতয়ালি থানার ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ডাকাতির আগে তারা পুরো এলাকা রেকি করেছে। ওই এলাকায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে কিনা সেটাও দেখেছে। তারা ভেবেছে সেখানে ক্যামেরা নেই, সুতরাং ডাকাতি করে চলে যাওয়া সহজ হবে।

সূত্র জানায়, ডাকাতির জন্য ১১ জন মাইক্রোবাসযোগে এসে পৌনে ৮টায় জিপিও’র কিছুটা দূরে সড়কের বিপরিত পাশে অবস্থান নেয়। ১১ জন সবাই গাড়ি থেকে নেমে দোকান দু’টির সামনে যায়। তিনজন গিয়ে গিণি গোল্ড জুয়েলার্সের মালিকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে স্বর্ণালংকার তাদের দেবার নির্দেশ দেয়। আরও তিনজন অপরুপা জুয়েলার্সে গিয়ে ডাকাতির চেষ্টা করে।

কোতয়ালি থানার ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, স্বর্ণ লুট করা নিয়ে বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে গিণি গোল্ড জুয়েলার্সের মেঝেতে একটি বোমা ছুঁড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু সেটা বিস্ফোরিত হয়নি। এরপর আরও একটি বোমা ছুঁড়ে মারা হয়। সেটি বিস্ফোরিত হয়ে এর স্প্লিন্টার গিয়ে পড়ে বোমাভর্তি ব্যাগে। একইসঙ্গে কমপক্ষে ১০টি বোমা একত্রে বিস্ফোরিত হয়ে বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়।

ওসি জানান, বিস্ফোরণে ডাকাত কালাম ও মনির গুরুতর আহত হয়ে সেখানে লুটিয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ বাবুলও সামান্য আহত হন। এসময় ছয়জন দ্রুত মাইক্রোবাসে উঠে পালিয়ে যায়।   বাবুল ও আরেকজন মাইক্রোবাসে উঠতে না পেরে অটোরিক্সা করে পালিয়ে যায়। তবে পাহাড়তলীতে পুলিশের চেকপোস্টে বাবুল ধরা পড়ে।

মাইক্রোবাস নিয়ে পালিয়ে যাওয়া অন্যরা নিউমার্কেট ধরে সোজা পথে না গিয়ে বামে টার্ণ নিয়ে সদরঘাট দিয়ে পালিয়ে যায়। এসময় তারা পূর্ব মাদারবাড়ি গরীবে নেওয়াজ হোটেলের সামনে মাইক্রোবাসটি রেখে পালিয়ে যায়।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, নিউমার্কেট মোড়ে সিসি ক্যামেরা আছে। সেজন্য তারা ভেবেছিল যাবার পথে তারা ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাবে। সেজন্য ডাকাতরা বাম দিকে যেতে পারে বলে আমরা শুরুতেই ভেবেছিলাম। আমাদের ধারণাই সত্যি হয়েছে।

কোতয়ালি থানার ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, একসঙ্গে বেশি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বলেই অনেকে হতাহত হয়েছে। একটি, দু’টি বোমা বিস্ফোরিত হলে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতনা।

শনিবার রাতে নগরীর আলকরণের প্রবেশমুখে হাজী দানু মিয়া সওদাগরের মালিকানাধীন অপরুপা জুয়েলার্স এবং জুয়েলারি সমিতির সহ সভাপতি রতন ধরের মালিকানাধীন গিণি গোল্ড জুয়েলার্সে এ ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

ডাকাতি শেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া বোমায় আহত সৈয়দ (৪৫) নামে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে মারা যান। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন আরও ৯ জন।

ডাকাতি ও বোমা হামলার ঘটনায় নগরীর কোতয়ালি থানায় ১১ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন গিণি গোল্ড জুয়েলার্সের মালিক রূপন কান্তি ধর।

মামলার এজাহারে তিনি দাবি করেছেন, অপরুপা জুয়েলার্স ও গিণি গোল্ড জুয়েলার্স থেকে চার লক্ষ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের মোট সাড়ে ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে চার ভরি ওজনের চারটি গলার হার, দুই ভরি ওজনের দুই জোড়া কানের দুলসহ বিভিন্ন স্বর্ণালংকার আছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমতিয়াজ বাবুলের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নগরীতে এর আগে কমপক্ষে এক’শ থেকে দেড়’শ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। ২০০৯ সালের আগে বাবুলকে গ্রেপ্তারে জোরালো চেষ্টা করেছিলেন কোতয়ালি ও খুলশি থানায় দায়িত্ব পালনকারী তৎকালীন উপ-পরিদর্শক ও বর্তমানে বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন। কিন্তু বাবুলের নাম-ঠিকানা কিংবা তার বিষয়ে বিস্তারিত অবগত ছিলনা পুলিশ।

বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালের আগে চট্টগ্রাম শহরে দিনে ডাকাতি হত। বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় আমরা তদন্ত করে পেয়েছিলাম, চোখে সুরমা লাগানো, জিন্স প্যান্ট ও কেডস পরা স্মার্ট কিছু যুবক এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। তখন আমরা বাবুল নামে একজনের তথ্য পেয়েছিলাম। কিন্তু তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় তখন কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে দিনে ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের মার্চে ঢাকার গুলশানে আমিন জুয়েলার্সে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ইমতিয়াজ বাবুল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সে জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর ২০১৩ সালের মার্চে যশোরে একটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি শেষে পালিয়ে যাবার পথে মাগুরায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত নভেম্বরে সে জামিনে বেরিয়ে আসে।

জামিনে বেরোনোর পর বাবুলের প্রথম টার্গেট ছিল জিপিও মোড়ের স্বর্ণের দোকান দুটি। তবে এ অভিযানেই তার মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে নগর পুলিশের কাছে।

এর আগে ২০০৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নগরীর জিইসি মোড়ে মদিনা টাওয়ারের মালিক নজরুল ইসলাম বাচ্চুর বাসায় বাবুলের নেতৃত্বে ডাকাতি সংঘটিত হয়। এসময় তাদের বাসা থেকে নগদ দু’লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ও ১৯ ভরি স্বর্ণালংকার, চারটি মোবাইল সেট লুট হয়।

বাচ্চু’র স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশের এস আই মিলন পরিচয় দিয়ে ডাকাতদল আমার বাসায় ঢুকেছিল। আমার মেয়ের মাত্র চার মাস আগে বিয়ে হয়। সে বাসায় বেড়াতে এসেছিল। তার সব স্বর্ণালংকার ডাকাতরা লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ছেলেমেয়েদের বাথরুমের ভেতরে বেঁধে রেখেছিল।

এর দু’দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি নাসিরাবাদ ভূঁইয়া গলিতে গাইনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা.তাহের খানের বাসায় ডাকাতি করে বাবুলের নেতৃত্বে তার বাহিনী।

২০০৭ সালে খুলশিতে প্রকৌশলী মো.মোস্তফার বাসায়, বাদুরতলায় ডা.মোজাম্মেল হোসেনের বাসায়, প্যারেড কর্ণারে গাড়ি ব্যবসায়ী আকবর হোসেনের বাসায় ডাকাতি করেছিল বাবুল বাহিনী।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পতেঙ্গায় একটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির পর বাবুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল। তবে সঠিক পরিচয়, ঠিকানা নিশ্চিত করতে না পারায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি তার নাম অভিযোগপত্রে বাদ দিয়েছিল বলে সূত্র জানিয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ইমতিয়াজ বাবুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জে। একসময় সে চট্টগ্রাম শহরে সিএনজি অটোরিক্সা চালাত। ২০০৪ সালের দিকে ডাকাতিতে জড়িয়ে নিজেই একটি আন্ত:জেলা ডাকাতি বাহিনী গড়ে তুলে। পাঁচ বছরে সে প্রায় দেড়’শ ডাকাতি করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।

ডাকাতির টাকায় সেখানে সে একটি পাকা দালান নির্মাণ করেছে। তার প্রথম স্ত্রী সেখানে থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবুল নগরীর ইপিজেড এলাকায় থাকত। সম্প্রতি বাবুল কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পূর্ব ফয়’জলেক এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪

** বোমায় আহত একজনের মৃত্যু
** চট্টগ্রামে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি, বোমায় আহত ১০
** স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি মামলার হোতা বাবুল রিমাণ্ডে
** সাড়ে ৪ লক্ষ টাকার অলংকার লুট, দু’মামলা

স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি মামলার হোতা বাবুল রিমাণ্ডে
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।