ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আবারও হাতছাড়া ফারদিন

জেএমবির আস্তানায় ‘স্পর্শকাতর নথি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
জেএমবির আস্তানায় ‘স্পর্শকাতর নথি’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সামরিক কমাণ্ডারের আস্তানা থেকে বেশকিছু গোপন ও স্পর্শকাতর নথিপত্র পেয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।   এসব নথিপত্রের মধ্যে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জারি করা একটি স্পর্শকাতর নির্দেশনাও আছে।

  গোপন আদেশের নথি জঙ্গিদের কাছে কিভাবে পৌঁছল তা নিয়ে বিস্মিত খোদ পুলিশ।

এছাড়া শহরের উপকণ্ঠে জনবহুল এলাকায় এসে কিভাবে আস্তানা গড়ে তুলতে পেরেছে জেএমবির সামরিক কমাণ্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস তা নিয়েও বিস্মিত পুলিশ।
  তবে এবারও ফারদিন পুলিশের হাতছাড়া হয়েছে।   আস্তানায় অভিযান চালিয়েও তাকে পায়নি নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, জেএমবির আস্তানায় বেশকিছু সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ডায়েরি পেয়েছি।   সেখানে আমাদের কিছু স্পর্শকাতর ডকুমেন্টও আছে।   তদন্তের স্বার্থে এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবেনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে জঙ্গিদের বহনকারী পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে দেয় তাদের সহযোগীরা।   এ ঘটনার পর নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি গোপন চিঠি দেশের সকল ইউনিটে পাঠানো হয়।   চিঠির বিষয়বস্তু এতটাই স্পর্শকাতর যে ইউনিট প্রধানের কাছেই সেটা সংরক্ষিত থাকার কথা।   কিন্তু সেই চিঠির অনুলিপি জেএমবির সামরিক কমাণ্ডারের আস্তানা থেকে উদ্ধার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

তবে চিঠিতে কি ধরনের তথ্য আছে সে বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউই।   ঘটনাস্থলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য, নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার কুসুম দেওয়ান, অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে ‍যান।

জেএমবির আস্তানা থেকে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট, বেইজ  র‌্যাংকও উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর সঙ্গে পেয়েছে জেএমবি’র কাজের ছক সংক্রান্ত সাংগঠনিক মানচিত্র, ডায়েরিতে সাংকেতিক বিভিন্ন নির্দেশনা ও সংকেত, কর্মকাণ্ডের বিবরণ।   ডায়েরির উপরে লেখা আছে ‘রোহিত দাশগুপ্ত’।   দাওয়াতী ও জিহাদি বিভিন্ন বইপত্রও উদ্ধার হয়েছে সেখান থেকে।   পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর বইপত্র, খাতা ওই আস্তানা থেকে উদ্ধার করেছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এস আই) সন্তোষ কুমার চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, জেএমবি’র সাংগঠনিক বিভিন্ন দলিলপত্র আমরা উদ্ধার করেছি।   একটা মানচিত্র পাওয়া গেছে।   এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।   গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসম্বলিত একটি চিঠিও পেয়েছি।

জেলার হাটহাজারী থানার অধীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমানবাজারে একটি বাড়িতে আস্তানা গড়ে তুলেছিল জেএমবির সামরিক কমাণ্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস।   নগর গোয়েন্দা পুলিশ শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত একটানা ওই আস্তানায় অভিযান চালায়।   

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের আমানবাজারে জয়নব কমিউনিটি সেন্টারের পাশের রাস্তা দিয়ে আনুমানিক এক’শ গজ দূরে হাজী ইছহাক ম্যানশন নামে একটি দোতলা বাড়ি।   এর নিচতলার বাসা ভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন জেএমবির সামরিক কমাণ্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস।

বাড়ির মালিক হাজী মোহাম্মদ ইছহাক বাংলানিউজকে জানান, ছয় মাস আগে মাসে ছয় হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল আনুমানিক ৩২ থেকে ৩৫ বছরের এক যুবক।   এসময় সে নাম বলেছিল নাফিস।   সে শহরে ব্যবসা করে বলে জানিয়েছিল।   তার স্ত্রী ও এক বছর বয়সী এক ছেলে ছিল।   ভাড়া নেয়ার সময় তাদের মূল বাড়ি ঢাকায় বলে ‍জানিয়েছিল।

ইছহাক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঘর খালি হওয়ার পর আমি নোটিশ দিয়েছিলাম।   সেটা দেখে নাফিস আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে।   প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যাচেলর।   তাই না করে দিয়েছিলাম।   কিন্তু সে বলল তার স্ত্রী-সন্তান আছে।   এরপর ভাড়া দিয়েছি। ’

ভাড়াটিয়ার নাম ও মোবাইল নম্বর পুলিশকে দিয়েছেন হাজী ইছহাক।

তিনি জানান, নাফিসের মোটর সাইকেল ছিল।   তবে বাসায় বেশি থাকত না।   সবসময় স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে বাইরে থাকত।   মাসে বড়জোড় ৭-৮দিন বাসায় থাকত।   তার স্ত্রী বাসা থেকে তেমন বের হত না।   তবে মাঝে মাঝে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথা বলত।

‘তাদের ব্যবহার ছিল অমায়িক।   নীচু স্বরে কথা বলত।   আমি কোনদিন বুঝিনি তারা বাসার ভেতরে এসব করছে।   আমি তো এখন পুরা হতবাক।   এসব কি করল তারা।   এগুলো কি মুসলমানের কাজ ? বোমা মেরে কাউকে হত্যা করা কি একজন ধার্মিক মুসলমানের কাজ ?’ বলেন ইছহাক।

তিনি জানান, ৮-১০ দিন আগে ঢাকায় বাড়ি যাবার কথা বলে নাফিস স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে চলে যায়।   এরপর থেকে বাসা তালাবদ্ধ ছিল।   ওই বাসা থেকে যাকে আটক করা হয়েছে তাকে তিনি চিনেন না।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে বাসা থেকে রাসেল নামে একজন জেএমবি সদস্য আটক হয়েছে।   ফয়সাল ও নয়ন নামে আরও ‍দু’জনকে শহর থেকে আটক করে অভিযানের সময় সেখানে নিয়ে যায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, নাফিস নাম ব্যবহার করে ভাড়া নিয়ে মূলত ফারদিনই বাসাটিকে তার আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছিল।   ফারদিনকে আমরা এবারও ধরতে পারিনি।   তবে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

এর আগে ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় জেএমবির আরও একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছিল বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।   এসময় সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ হ্যাণ্ড গ্রেনেড ও বিস্ফোরকসহ পাঁচজন গ্রেফতার হয়।   পরে নিজের ছোঁড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে একজন মারা যায়।  

জেএমবির বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমাণ্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াসের খোঁজেই মূলত নগর গোয়েন্দা পুলিশ খোয়াজনগরের আস্তানায় অভিযান চালিয়েছিল।   কিন্তু সেখানেও ফারদিনকে পায়নি পুলিশ।

বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ফারদিনের মূল আস্তানা ছিল আমানবাজারের বাসা।   খোয়াজনগরে সে বিস্ফোরক মজুদ করেছিল।   তাদের আরও কোন আস্তানা আছে কিনা সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫ 
আরডিজি/টিসি

** জেএমবি কমান্ডারের আস্তানায় অভিযান, অস্ত্র-গুলিসহ আটক ৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।