ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সকালে পেল নতুন বই, রাতে নিয়ে গেল আগুন

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৭
সকালে পেল নতুন বই, রাতে নিয়ে গেল আগুন পুড়ে যাওয়া বই খুঁজে ফিরছে তারা। ছবি: সোহেল সরওয়‍ার, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: মাসখানেক আগে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে একরত্তি শিশুটির পৃথিবীতে শুধু দুটি শব্দ ছিল-‘নতুন বই’। কিছুদিন ধরে বড় বোনকে বারবার বলে যাচ্ছিল-আপু কবে দেবে নতুন বই? রোববার তার সেই ‘স্বপ্ন’ পূরণ হয়েছিলও। অন্যদের মতো তার হাতেও এসেছিলো নতুন বই। কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায় ভালোমতোন হাত বুলার আগেই ‌আগুন সবকিছুর মতো নিয়ে গেছে তার সেই বই-ও।

এই শিশুটির নাম ঝুমুর আক্তার। সে বাবা মা ও বোনকে নিয়ে থাকতো সদরঘাট থানা এলাকার মাইল্লার বিল বস্তিতে।

সম্প্রতি সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে পূর্ব মাদারবাড়ি ইউনূস মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। রোববারের রাতের আগুন যে বস্তির সবকিছু মুছে দিয়েছে।

আগুনে কি ক্ষতি হলো, না হলো, তা ভালোমতোন বুঝার বয়স এখনও অব্দি হয়নি চারের আশেপাশে বয়সের ঝুমুরের। তবে একটা জিনিস বেশ ভালোই বুঝছে সে-তার নতুন বইগুলো আর নেই।

সোমবার সেই বস্তিতে অন্যরা সবাই যখন বিক্রি করার জন্য পোড়া টিন খোঁজাখুজি নিয়ে ব্যস্ত তখন সে খুঁজছে তার বই। অবশ্য পুড়ে যাওয়া বইয়ের স্মৃতিচিহ্ন কিছু পেলও সে।

তাতে হাত বুলাচ্ছে, আর বলছে-‘এটা ‍আমার বই। রোববার স্কুলে স্যাররা দিয়েছিল। রাতের আগুনে পুড়ে গেছে। ’

ঝুমুরের বাবা দিনমজুর আক্তার হোসেন বলেন, আমার বড় মেয়ে নাসিমা এবার তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। সে এখনও নতুন বই পাইন। মঙ্গলবার পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ছোট মেয়ে ঝুমুর বছরের প্রথমদিনেই নতুন বই পেয়েছিল। গত বছর বোনের কাছে নতুন বই দেখাটা তার মনে ছিল। তাই এবছর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সে নতুন বইয়ের আশায় ছিল। রোববার সকালে বই পাওয়ার পর দিনভর বইগুলো নিয়ে ছিল। বইগুলো পাশে রেখেই রাতে ঘুমাতে গিয়েছিল সে। কিন্তু রাতের আগুন আমার অন্য সবকিছুর মতো বইগুলোও প্রায় পুড়ে ফেলেছে। ’পুড়ে যাওয়া বই খুঁজে ফিরছে তারা, পুড়ে যাওয়া বই খুঁজে ফিরছে তারা।   ছবি: সোহেল সরওয়‍ার, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শুধু ঝুমুর না, এই বস্তিতে তার মতো মা-বাবাদের নিয়ে আরও বাস করে আরও অনেক শিশু। তাদের প্রায় সবাই পাওয়ার প্রথমদিনেই নতুন বই হারিয়েছে।

তাদের আরেকজন আয়েশা আক্তার। সে পূর্ব মাদারবাড়ি ইউনূস মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

বাম পায়ে ব্যান্ডেজ। ‘বিধ্বস্ত’ চেহেরাটা আগুনে পুড়ে যাওয়া আসবাব থেকে সৃষ্ট কালি লেগে আরও মলিন দেখাচ্ছে। বস্তির বাইরে উদ্ধার করা ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের বস্তার উপর বসে ছিল সে নির্বাক আয়েশা।

কথা হলে সে বলে, ‘বই নিয়ে বের হতে পারি নি। প্রাণ নিয়ে বের হতে পেরেছি তাও যেন অনেক বেশি। দ্রুত বের হতে গিয়ে পায়ে মারাত্মক চোট পেয়েছি। সকালে ব্যান্ডেজ লাগিয়েছি। ’ তার আফসোস, নতুন বইগুলো যে ভালোভাবে একবার ভালোভাবে দেখাও যে হলো না।

এই বস্তিতে ৩১ জন মালিকের অধীনে প্রায় এক হাজার ছোট বাসা ছিল। এছাড়া ১৫টি দোকানও ছিল এই বস্তিতে। সবমিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষ থাকতো এই বস্তিতে। এর মধ্যে ২৬ জন মালিকের মালিকানাধীন ৯০০ এর উপর বাসা পুড়ে গেছে।

ঝুমুদের মতো যারা আগুনে নতুন বই হারালো তারা হয়তো আবারও নতুন বই পাবে। হয়তো কয়েকদিনের মাথায় তাদের হাতে আসবে নতুন বই। কিন্তু শিশুমনে যে এই অপেক্ষ‍ার কাছে আটকে থাকাটাও তো অনেক বড় মনখারাপের বিষয়।

ঘুম ভাঙে ‘আগুন আগুন’ ডাকে

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৭

টিএইচ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।