দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের প্রিয় ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। খোঁজ-খবর রাখতেন সাংবাদিদের।
ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিনের একনিষ্ট ভাবনা ছিল মানবসেবা। আর তা করতেও পেরেছেন। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে তার জানাজার নামাজ।
যেখানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম তো আছেই দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকেও শেষবার মহিউদ্দিনকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন। অনেকের চোখ থেকে নেমে এসেছে বাঁধ না মানা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
অনেকে তো বলেই ফেললেন, ‘চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে তার মতো আর কেউ আন্দোলনে নামবেন না। ’
পড়ুন>>
** চট্টল বীরের জীবনাবসান
চট্টল বীরের চির বিদায়ের দিন থেকেই একটা স্মৃতি বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সেই স্মৃতিমন্থনের ভাষা প্রকাশই যেনো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তার মৃত্যুর তিনদিন পেরিয়ে গেলেও আমার মতো এখনও চট্টগ্রামবাসীর মনে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানুষটির চলে যাওয়া।
দেশে তখন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। ওয়ান ইলেভেনের ওই সময়টায় মামলা দেওয়া হয় মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
তখন তার চশমা হিলের বাড়িটি অনেকটা ‘ভুতের বাড়ি’তে পরিণত হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরে থাকতো বাড়িটি। যেখানে গেলে কেউ কোনোদিন না খেয়ে ফিরতে পারেননি। পরম মমতায় মানুষকে কাছে ডেকে খাওয়াতেন তিনি।
ওই সময়টাতেই তার সঙ্গে দেখা করতে যাই চশমা হিলের বাড়িতে। আমাকে দেখেই যেনা চমকে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘এখানে কেন এসেছো? সবার নজর এখন এখানে। চলে যাও। ’
উত্তরে আমি বললাম, ‘আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। খোঁজ-খবর নিতে এসেছি। ’
তবে তিনি বেশিক্ষণ আমায় সেখানে থাকতে দেননি। বলছিলেন, ‘চলে যাও। আমাকে ওরা অ্যারেস্ট করবে, ওদের শর্ত আমি নাকচ করে দিয়েছি, আমি মহিউদ্দিন চৌধুরী, আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, আমি প্রতিবাদ করবোই। ’
আসলে পোড় খাওয়া রাজনীতিক মহিউদ্দিন চৌধুরী জানতেন তিনি গ্রেফতার হচ্ছেন। আত্মগোপন তো দূরে থাক, তার স্বভাবজাত কথাও বন্ধ করেননি।
এরপর গ্রেফতার হয়ে জেলে যান তিনি। আর ওই সময়টাতেই তার মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার ক্যান্সার ধরা পড়ে। ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেয়েকে দেখতে পরিবার প্যারলে মুক্তি চাইলে মহিউদ্দিনকে ‘রাজনীতি ছাড়ার’ শর্ত দেওয়া হয়।
মৃত্যুশয্যায় মেয়েকে দেখতে না পেলেও সেই শর্ত মানতে রাজি হননি এই নেতা। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পেয়েও চট্টগ্রামকে ছেড়ে দূরে যাননি কখনও। গর্ব করে তিনি বলতেন, ‘আমি চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন। ’
পরে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর জামিনে মুক্ত হন মহিউদ্দিন। কিন্তু ব্যাংককের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ত্যাগের আগেই শুনেন টুম্পার মৃত্যু সংবাদ। ওইদিন বেশ কেঁদেছিলেন জননেতা।
সাংবাদিকদের জন্যও এমনই অভিভাবক তুল্য পরম মমতা ছিল তার হৃদয়ে। তার উদ্যোগেই জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়, যাকে আজ এখানকার সাংবাদিকরা ‘সেকেন্ড হোম’ মনে করেন।
উৎসব পার্বণে সাংবাদিকদের জন্যে উপহার পাঠাতেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কেউ নিতে না চাইলে স্নেহের ‘বকুনি’ও দিতেন যা শুনে কেউ আর না করতে পারতেন না।
শুধু সাংবাদিকই নয়, তার কল্যাণে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় থিয়েটার ইনস্টিটউট। শিক্ষা আর পরিচ্ছন্ন সবুজ চট্টগ্রাম উদ্যোগের কথা তো সরাই জানা।
কুলি-শ্রমিক মজুর থেকে বিশিষ্টজনদের প্রিয় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে চট্টগ্রাম আজ শোকস্তব্ধ। প্রিয় নেতাকে হারিয়ে এসব মানুষ শোক হয়তো কাটিয়ে ওঠবে- তবে আজীবন মনে রাখবে তার ভালোবাসা মাখানো স্মৃতির কথা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭
টিসি/