ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মহিউদ্দিনের রাজনীতির হাল ধরবেন কে ?

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৭
মহিউদ্দিনের রাজনীতির হাল ধরবেন কে ? এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির প্রাণপুরুষ ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।  বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল আনুগত্য, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ক্যারিশমা, চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন মনোভাব এবং জনগণের প্রতি ভালোবাসায় গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন।  আজ মহিউদ্দিন নেই।  কিন্তু তার আদর্শের অনুসারী লাখো নেতাকর্মী আছেন এই চট্টগ্রামে।  মহিউদ্দিনের অনুপস্থিতিতে এই লাখো নেতাকর্মীর মাথার উপর ছায়া হবেন কে, শোকের মধ্যেও এই প্রশ্ন এখন তাদের মধ্যে।

মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।  উচ্চশিক্ষিত এই তরুণের মধ্যে মহিউদ্দিনের ছায়া দেখতে পান অনুসারীদের বড় অংশ।

 

আবার মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা খোরশেদ আলম সুজনকে সামনে রেখে এগিয়ে যাবার পক্ষেও মত এবং আবেগ-অনুভূতি আছে এদের ভেতরেই। একেএম বেলায়েত হোসেন, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, জহিরুল আলম দোভাষ এবং ‍আবদুচ ছালামের ছায়াতলে গিয়ে রাজনীতি করার আলোচনাও আছে মহিউদ্দিনের অনুসারীদের মধ্যেই।

বাবার পাশে নওফেল

তবে মহিউদ্দিন অনুসারীদের বড় অংশ নওফেলের পক্ষে একাট্টা হলেও তাকে চট্টগ্রামের গ্রুপিং রাজনীতিতে টেনে আনার বিপক্ষে মতও আছে।

সদ্য বাবা হারানো নওফেলের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পুরো পরিবার একটা শোকের সময় পার করছি।   নেতাকর্মীরাও এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি।   এখন এসব বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছা আমার নেই।

কয়েকবার অনুরোধের পর নওফেল বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর শেখ হাসিনার নেতৃত্ব-এই রাজনৈতিক আদর্শই আমার বাবা আমাকে দিয়ে গেছেন।   এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আমি সবার সমর্থন প্রত্যাশা করছি।   সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাব।

স্কুলজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের কর্মী ছিলেন মহিউদ্দিন।  ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগে।   ১৭ বছর চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন।   শেষবার হারলেও মাঠ ছেড়ে যাননি।   খালেদা-এরশাদবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের মাঠ দখলে রাখার অন্যতম নায়ক ছিলেন মহিউদ্দিন।  নিজের দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বন্দরসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে বারবার রাজপথে দাঁড়িয়েছেন।

জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কন্ঠে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই মহিউদ্দিন ‍ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতি করছি।   রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত একসঙ্গে পার করেছি।   অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করা, মানবতার ডাকে ছুটে যাওয়া আর দলের নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা এটাই ছিল মহিউদ্দিন ‍ভাইয়ের রাজনীতি।   এই রাজনীতি দিয়েই তিনি আমাদের মতো ভাবশিষ্য তৈরি করেছেন।  

‘জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিভাবকের ছায়ায় ছিলাম।   সকল প্রতিবাদ-প্রতিরোধে উচ্চকন্ঠ নিয়ে মহিউদ্দিন ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছি।   সেজন্য অনুসারীরা মহিউদ্দিন ভাইয়ের ভাবশিষ্য হিসেবে আমাকে ভালোবাসেন।   তবে আমি চাই, মহিউদ্দিন ভাইয়ের সুযোগ্য সন্তান নওফেল কেন্দ্রীয় রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রামেও যেন হাল ধরেন।   আমরা নওফেলকে সহযোগিতা করে যাব। ’ বলেন সুজনমহিউদ্দিনের পাশে ভাবশিষ্য খোরশেদ আলম সুজন

এক দশক আগেও মহিউদ্দিনের পাশের ‍ছায়ার মতো ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি ডা.আফছারুল আমিন ও ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল এবং কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।   কিন্তু ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিনের পরাজয়ের পর আফছারুল আমিন আলাদা বলয় গড়ে তুললে বাবুল ও ছালাম সেই বলয়ে যোগ দেন।   আফছারুল আমিনের মন্ত্রীত্বকাল শেষ হবার পর দুজনই আবার ফিরে আসেন মহিউদ্দিন শিবিরে।

ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, কিভাবে রাজনীতি করতে হবে সেই কর্মপদ্ধতি এবং দিকনির্দেশনা মহিউদ্দিন ভাই আমাদের দিয়ে গেছেন।   তাঁর অবর্তমানে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন সেটা এই মুহুর্তে বলা সম্ভব নয়।   কারণ মহিউদ্দিন ভাই দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন।  

নওফেল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাবার রাজনৈতিক আদর্শে যদি অবিচল থাকে, তবেই বাবার যোগ্য সেনাপতি হতে পারবে নওফেল।

আবদুচ ছালাম বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক উত্তরসূরী বসিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়।   মহিউদ্দিন ভাই নিজের কর্ম দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।   কর্মের মধ্য দিয়েই মাঠ থেকে উঠে আসবেন মহিউদ্দিন ভাইয়ের উত্তরসূরী, যিনি উনার আদর্শের লাখ লাখ কর্মীকে নেতৃত্ব দেবেন।  

নগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা আলাপে বলেন, নওফেলকে চট্টগ্রামে এনে গ্রুপিং রাজনীতিতে জড়ানো উচিৎ হবে না।   নওফেল কেন্দ্র থেকেই তার বাবার অনুসারীদের ছায়া দিলে সেটাই বরং ভাল হবে।   তবে নওফেল যদি ছায়া দিলেও চট্টগ্রামে যদি একজন শক্তভাবে হাল না ধরেন, সেক্ষেত্রে মহিউদ্দিনের অনুসারীদের অনেকেই বিরোধী শিবিরে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে।  সেক্ষেত্রে খোরশেদ আলম সুজনের বিকল্প নেই।

দু:সময়েও মহিউদ্দিনকে ছেড়ে না যাওয়া অনুসারীদের অন্যতম নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ।   তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অনেকে মহিউদ্দিন ভাইকে বলতেন-আপনি তো নেতা তোলেননি, আপনার মৃত্যুর পর কে হাল ধরবে? মহিউদ্দিন ভাই বলতেন-নেতা তুলতে হয় না।   মাঠে-ঘাটে কাজ করে যিনি জনগণ এবং কর্মীর মন জয় করতে পারেন তিনিই নেতা।  জনগণই নেতা বানায়।

‘মহিউদ্দিন ভাই নওফেলের বিষয়ে আমাদের বলতেন।   নওফেল সাংগঠনিক সম্পাদক হবার পর আমাদের বলেছেন, ঢাকায় একজনকে আমি সেট করে দিলাম।   তোমরা তোমাদের কথাবার্তা তাকেও জানাতে পারবা। ’ বলেন ফরিদ মাহমুদবাবার পাশে নওফেল

মহিউদ্দিনের পক্ষে উচ্চকন্ঠ নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রণি বাংলানিউজকে বলেন, মহিউদ্দিন ভাই আমাদের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন আর চেতনা দিয়ে গেছেন।   তিনি না থাকলেও তাঁর খালি চেয়ারটাই আমাদের লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ঠ।   মহিউদ্দিন ভাইয়ের মতো নওফেল ভাই শুধু আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকলে হবে।   আমাদের জন্য লবিং-তদবিরের দরকার নেই।  

গত ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাত ৩টায় জীবনাবসান ঘটে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৭

আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।