ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দিয়াজ হত্যার পাঁচ বছর

‘গর্ভধারিণীই বুঝবেন আরেক গর্ভধারিণীর কষ্ট’

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২১
‘গর্ভধারিণীই বুঝবেন আরেক গর্ভধারিণীর কষ্ট’ ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম: কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও তদন্তে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন দিয়াজের পরিবার।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, আসামিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় এগোচ্ছে না তদন্ত। দুই আসামি জামিনে, অন্যরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও তদন্তকারী সংস্থার আগ্রহ নেই আসামিদের গ্রেফতারে।

উল্টো আসামিরা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।

২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজের ঝুলন্ত মরদেহ। এ ঘটনার তিনদিন পর ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়।  

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণকাজের দরপত্র নিয়ে কোন্দলের সূত্র ধরে এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ বলে শুরু থেকেই দিয়াজের পরিবার ও তার অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মীরা দাবি করে আসছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা করেন।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মনসুর আলম, সহ-সভাপতি আবদুল মালেক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবু তোরাব পরশ, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আরমান, প্রচার সম্পাদক সম্পাদক রাশেদুল আলম জিশান, অপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান ও সদস্য আরিফুল হক অপুকে আসামি করা হয়।  

জাহেদা আমিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দিয়াজের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর মরদেহ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে আঘাতজনিত জখমের মাধ্যমে হত্যার আলামত আছে।

এর প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। ওই সময়কার ওসি বেলাল উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নিজেই তদন্ত শুরু করেন। পরে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডির কাছে। সিআইডির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার অহিদুর রহমান তদন্ত শুরুর পর বদলি হন। এরপর থেকে আরও দু’জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। তিনবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলে বর্তমানে সিআইডি চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম তদন্ত করছেন।

আদালত সূত্র জানায়, দিয়াজ হত্যা মামলায় তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ, প্রচার সম্পাদক রাশেদুল আলম জিশান হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন। পরে আনোয়ার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি তিনজন নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়াও তৎকালীন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আরমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলার আসামির মধ্যে আনোয়ার ও আরমান জামিনে রয়েছে। দিয়াজের বান্ধবী প্রিয়াঙ্কা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিল।

এদিকে, যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে র্যা ব। গ্রেফতারের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবন নির্মাণের ৭৫ কোটি টাকার কাজ জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান সার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স জি কে বিল্ডার্স লিমিটেডকে (জেভি) পাইয়ে দিতে ‘বাধা অপসারণের অংশ হিসেবে’ দিয়াজকে খুন করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যকে ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে মামলায় তাকে আসামি করার আবেদন করেন দিয়াজের মা।  

২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর গ্রেফতার হওয়া আলোচিত সাবেক যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে দিয়াজ হত্যা মামলায় আসামি করার জন্য আদালতে আবেদন করেন তিনি। আদালত সেটা নথিভুক্ত করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বরাবর পাঠান বলে জানান বাদির আইনজীবী জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা।

মামলার বাদী ও দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘টাকা ও ক্ষমতার কাছে যদি সবাই বিক্রি হয়ে যায়, আমি কি বলবো? মামলার কারণে প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, দুই একজন খুনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে অবৈধভাবে থাকছে। আমি আগেও বলেছি, আমার একটা প্রত্যাশা-আমার নিশ্বাস ত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করে যাবো। আমি ঘর ভাঙচুরের সময় সব আসামিকে নিজ চোখে দেখেছি। কিন্তু খুনের সময় নিজ চোখে দেখিনি। আমি যাদেরকে আসামি করেছি, এর বাইরেও আসামি আছে’।

তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করতে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দেওয়া হচ্ছে। একজন দোকানদার এই মামলার সাক্ষী। ‘তার বর্ণনামতে, ঘটনার আগে দিয়াজ রাত দুইটার দিকে নাস্তা ক্রয় করতে এসেছিল দোকানে। দিয়াজের পরনে ছিল একটি হলুদ টি-শার্ট ও ট্রাউজার ছিল’। কিন্তু দিয়াজকে হত্যার পর রক্তাক্ত কাপড়গুলো পাল্টে অন্য কাপড় পড়ানো হয়। সিআইডি বলছে এসব বাদ দিতে। এছাড়া এক মেয়েও সিআইডির কাছে বক্তব্য দিয়েছে, ঘটনার সময় সেখানে মেয়েটি উপস্থিত ছিল। কিন্তু তাকে আসামি করা হয়নি। আমার প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেলে দিয়াজ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতাম। গর্ভধারিণীই বুঝবেন আরেক গর্ভধারিণীর কষ্ট।  

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, দিয়াজের মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্তে কিছু অগ্রগতি হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২১
এমআই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।