ঢাকা: কোরবানির চামড়া ক্রয়–বিক্রয়ের দেশের সবচেয়ে বড় জায়গা রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তা। সারা বছরের চামড়ার প্রায় অর্ধেকই আসে কোরবানির ঈদের মৌসুমে।
এছাড়া এ বছর ব্যবসায়ীদের কাছেও পর্যাপ্ত অর্থ ও লবণ মজুদ রয়েছে। ফলে পোস্তায় সময় মতো নিয়ে এলেই কোনো চামড়া ফেরত যায়নি। দামও ভালো পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। সব কিছু মিলিয়ে গত বছরের থেকে কম হবে। সেটা ১০ শতাংশের কম বা ৭-৮ শতাংশ চামড়া এবার নষ্ট হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলেন, গত কয়েক বছর ব্যাপক প্রচারণা করাতে ঢাকার চামড়া ঢাকায় লবণ দেওয়া এবং ঢাকার বাইরের চামড়া যে স্থানের সেখানে লবণ দেওয়ার বিষয়টি সকলে গ্রহণ করেছে। ফলে এ বছর চামড়ার ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে। এতে পোস্তায় চামড়া আসা কমেছে। বৃষ্টি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঢাকা আশেপাশে ও হেমায়েতপুরের ট্যানারিতেও চামড়া সময়মতো লবণজাত করতে পেরেছে। ব্যাপক প্রচারণার ফলে এটি করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। সেজন্য এবার চামড়ার বাজার গত কয়েক বছরের চেয়ে ভালো ছিল।
জানা গেছে, কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা নিয়ে এবারও যেন দেশে নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। সে জন্য শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাজার সম্প্রসারণ, ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং ফিনিশড লেদার উৎপাদনে সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নির্ধারণের ওপর জোর দিয়েছে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এ দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। সে সব বৈঠকে ব্যবসায়ীরা এ শিল্প খাত বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারাদেশে কমদামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি।
এ বছর কোরবানির পশুর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে ৩ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর খাসি ও বরকির চামড়ায় দাম গতবারের মতোই রাখা হয়েছে। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর খাসি বরকির চামড়ার দাম গতবছরের দামই রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবতাফ খান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গত বছর লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চামড়া ক্রয় করতে পেরেছি। এ বছর আমরা পোস্তায় ৭০ হাজার পিস চামড়া সংরক্ষণ করতে পেরেছি। একইসঙ্গে ঢাকার আশেপাশে আরো ৭০-৮০ হাজার পিস সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেগুলোও দুই এক দিনের মধ্যে চলে আসবে। সব মিলিয়ে এ বছর পোস্তায় দেড় লাখ পিস চামড়া সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে কোরবানির ৮০ শতাংশ চামড়া সরাসরি ট্যানারিতে চলে যায়। আমাদের পোস্তায় আসে মাত্র ২০ শতাংশ চামড়া। এতে দিন দিন পোস্তা তার নিজের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। তবে চামড়া যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য লবণজাত করে চামড়া সংগ্রহের জন্য পোস্তার ব্যবসায়ীরা সাভার, হেমায়েতপুর, আমিনবাজার, বেড়িবাঁধ, কেরানিগঞ্জ, জিঞ্জিরা, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, মুন্সিগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখায় সে সুফল আমরা পাচ্ছি। চামড়া নষ্টের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আবতাফ খান বলেন, গতবছর বাংলাদেশে ১০ শতাংশ চামড়া পুরোপুরি নষ্ট হয়েছিল। আর গুণগতমান নষ্ট হয়েছিল ৫ শতাংশ চামড়ার। এ বছরও ঈদের তিন দিন বৃষ্টি থাকায় আমরা আশঙ্কা করেছিলাম বেশ কিছু চামড়া নষ্ট হবে। কিন্তু সরকারের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ ও ফড়িয়াদের সচেতনতা এবং সাত দিন ঢাকার বাইরের চামড়া ঢাকায় প্রবেশ করতে না দেওয়ায় চামড়া নষ্ট কম হয়েছে। যা গত বছরের থেকে কম হবে বা ১০ শতাংশের নিচে ৭-৮ শতাংশ হতে পারে। যা সহনীয় বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ছমির হানিফ অ্যান্ড সন্সের মালিক হাজী মো. ছমির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ৪৮ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। এখন পোস্তায় আগের মতো আর চামড়া আসে না। অনেক চামড়া সরাসরি ট্যানারিতে চলে যায়। চামড়া সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় মৌসুম হলো কোরবানির ঈদ। এই ঈদ ১৬ বছর শীতকালে হয় আবার ১৬ বছর বৃষ্টির মৌসুমে হয়ে থাকে। আমাদের প্রস্তুতিও সে রকম থাকে। এ বছর ঈদের তিন দিন বৃষ্টি হয়েছে। তবে সময় মতো আমাদের চামড়া লবণজাত করতে পেরেছি৷ তাই নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। যেটা নষ্ট হবে সেটা প্রতি বছরই ৮ থেকে ১০ শতাংশ হয়ে থাকে। সেটা হবেই কেউ সেটা বন্ধ করতে পারবে না। এবছর চামড়ার বাজার ভালো ছিল কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় চলতি বছর চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ভালো হয়েছে। কারণ এ বছর সরকার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সঠিক দামে বিক্রি করতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির প্রথম সাত দিন ঢাকার বাইরের চামড়া ঢুকতে দেবে না। ঢাকার চামড়াও বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো হয়েছে। এতে চামড়ার গুণগতমান ভালো থাকবে। এছাড়া এ বছর আমরা আগেই আড়তদারদের বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছি। ফলে তারা পর্যাপ্ত লবণ কিনে রাখতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, আমরা আগামী সপ্তাহ থেকেই লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করবো। এবার ৮০ থেকে ৮৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হতে পারে। গত বছরও এ রকমই কেনা হয়েছিল। প্রতি বছরই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। এ বছর সেটা কমে যাবে। কেন না সরকার যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়াসহ ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীরাও সচেতন হয়েছেন। সেজন্য চামড়া নষ্ট কিছুটা কম হবে বলে মনে করেন তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারাদেশে কোরবানি করা গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩ টি। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২ টি। গত বছরের তুলনায় এবার ৯১ হাজার ৪৯ টি গবাদিপশু বেশি কোরবানি হয়েছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম পশু কোরবানি হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০২৩
জিসিজি/এসআইএস