ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি

মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতির অবসান চান ব্যবসায়ীরা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪
মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতির অবসান চান ব্যবসায়ীরা

ঢাকা: বিশ্বাবাজার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে মূল্য শুল্কায়নে সরকারের দ্বৈত নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে একই নীতি চান।

এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয় বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুত এই নীতি পরিবর্তন করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে এক নীতি বাস্তবায়ন করা উচিত। সরকারি ও বেসরকারি মূল্য শুল্কায়ন একই পদ্ধতিতে হতে হবে। হয় তা ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে, না হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে।  

দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারদের অনুরোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কমিটি গঠন করে করতে যাচ্ছে। মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতির অবসানের জন্য এ কমিটির মূল্যায়ন ও সুপারিশের ভিত্তিতেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।  

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বিদ্যুতৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। পরে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।  

তারা আরও বলেন, বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে যে কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা এসেছে তার ফাইল যখন আসবে তখনই এটি নিয়ে মূল আলোচনা শুরু  হবে। তবে প্রাথমিক আলোচনায় এই কমিটিতে কারা থাকবেন সেই বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।  

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি খাতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য শুল্কায়নে একই নীতি বাস্তবায়নের বিষয়টি এখনই নির্ধারিত হবে নাকি পরের বাজেটের জন্য অপেক্ষা করা হবে, এরকম অনেক টেকনিক্যাল বিষয়ও আছে। বিষয়গুলো নিয়ে আগে এনবিআর বসবে, তারপর এগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে এ নিয়ে চিঠি চালাচালি হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর চট্রগ্রাম কাস্টম হাউস খালাস করার সময় ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্কায়ন করে। অন্যদিকে একই এইচএস কোডে যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে তাদের শুল্কায়ন করা হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে। এর সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস হাউস।  

পণ্যের ইনভয়েস ভ্যালুর ক্ষেত্রে পণ্যের ওপর আরেপিত কাস্টমস ডিউটি সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে বিপিসি। এর ফলশ্রুতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরবর্তী সময়ে বিপিসিকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের জন্য ডিমান্ড নোট করে থাকে। যা বিপিসি তার প্রাইসিং ফর্মুলায় অন্তর্ভূক্ত রাখে না। এখানে সরকারের সঙ্গে এনবিআরের দ্বৈতনীতি পরিলক্ষিত হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে অবশ্যই সরকারকে মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সবার জন্য একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন করতে হবে। তাহলেই অর্থসংকট কেটে যাবে এবং জ্বালানি তেল পাচার রোধ করাও সম্ভব হবে।  

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেহেতু একই পণ্য সেক্ষেত্রে একই ধরনের শুল্ক হওয়া উচিৎ। এতে সরকারেরও সুবিধা হয়। একই পণ্যে পার্থক্য হলে এখন যে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে সেক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। একই পণ্য একই কোডে একই ধরনের শুল্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আমার মতামত হচ্ছে এখন যেহেতু বাজারমূল্যের ফর্মুলা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করবে সুতরাং তাদেরও (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) হিসাব করতে সুবিধা হবে যদি একই ধরনের শুল্কায়ন করা হয়।

এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতির কারণে বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সও দিতে হচ্ছে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে যে পরিমাণ শুল্ক দিচ্ছে, বেসরকারি পর্যায়ে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে তারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। একই দেশে সরকারি ও বেসরকারি শুল্ক মূল্যায়ন পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কোন চিন্তা-ভাবনা থেকে এমন নীতি করেছে এটি ভালো করে দেখা দরকার।  

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এরই মধ্যে তিন-চারটি বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান একইনীতিতে মূল্য শুল্কায়নের বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। বিষয়টি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য এবং এটি এক্সিমিন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এই কমিটি থেকে যে সুপারিশ আসবে তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফ আমাদের ওপর ইনভয়েস ভ্যালুতে যেতে পিড়াপিড়ি করছে। কিন্তু ইনভয়েস ভ্যালুতে গেলে জ্বালানির মূল্য হঠাত্ করে উঠে যেতে পারে।

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু করেছে সরকার। সে হিসেবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সেপ্টেম্বরের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা, অকটেন ১২৫ টাকায় ও পেট্রলের ১২১ টাকা নির্ধারণ করা হয়।  

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭২ লাখ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেলই ব্যবহার হয়। বাকিটুকু চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪
আরকেআর/নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।