ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

বীমা কোম্পানিগুলোর চালচিত্র

সাঈদুর রহমান রিমন ও মুরসালিন হক জুনায়েদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১০
বীমা কোম্পানিগুলোর চালচিত্র

ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরেই সম্পদ এবং জীবন রক্ষা সংক্রান্ত বীমার ক্ষেত্রে বীমা গ্রহীতা সাধারণ মানুষ এবং বীমা কোম্পানিগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন।

বীমা কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, বীমা গ্রহীতারা কখনই বীমা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন না।

অন্যদিকে বীমা গ্রহীতা সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বীমা কোম্পানীগুলো সর্বদাই বীমার টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে এমন সব শর্ত জুড়ে দেন যা পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানা শর্তের ঝক্কি ঝামেলার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবিদারের সংখ্যা কম হওয়ায় পুরো টাকাই বীমা কোম্পানিগুলোর লাভ হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন ফুলে ফেঁপে বেড়ে উঠছে বীমা ব্যবসা। আর এমন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বীমা কোম্পানির সংখ্যাও বেড়ে চলছে।

এসব বিষয় নিয়েই বাংলানিউজ’র ধারাবহিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সাঈদুর রহমান রিমন ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুরসালিন হক জুনায়েদ। তাদের এ প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে এ খাতের নানা অসঙ্গতি।

দুর্ঘটনায় হতাহতদের ভাগ্যে জোটে না বীমা সুবিধা

দেশের বীমা কোম্পনিগুলোর কঠিন কঠিন শর্তারোপ, নানা টালবাহানা ও সরকারি উদাসীনতার কারণে সড়ক বা নৌ দুর্ঘটনায় হতাহতরা বীমা ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত প্রায় ২৪ বছরে যানবাহন দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বীমা খাতে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলোতে জমা হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ এ মূল টাকার সঙ্গে প্রতিবছরই যোগ হয়েছে লভ্যাংশ। হিসেব করলে আসল আর লাভ মিলিয়ে এ খাতে সংগ্রহের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

অথচ যানবাহন দুর্ঘটনা খাতে বীমা গ্রহীতাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্ঘটনায় হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না বলে সরকারের বীমা অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত কোনও হিসাবও রাখা হয় না।

গত ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের কত টাকা তিপূরণ দেওয়া (বীমা শোধ) হয়েছে-তার হিসাব সরকারি কোনও সংস্থার কাছে নেই। এমনকি চলতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক’জনের বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে সে হিসেবও জানাতে পারেনি বীমা অধিদপ্তরসহ বীমা কোম্পানির কর্মকর্তারা।

বীমা অধিদপ্তরের উপ-নিয়ন্ত্রক মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বীমা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতে বছরভিত্তিক সর্ব মোট কতগুলো বীমা হয়েছে বা কতজন ক্ষতিগ্রস্তকে বীমার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে- এ সংক্রান্ত কোনও তথ্যই বীমা অধিদপ্তরে নেই।

বাস-ট্রাক-মিনিবাস মালিকরা প্রতিবছর যাত্রী দুর্ঘটনার ‘বীমা প্রিমিয়াম’ আগাম পরিশোধ করলেও সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতরা এ বীমা সুবিধা মোটেও পান না বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার ১৯৮৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য ‘সড়ক দুর্ঘটনা বীমা’ পদ্ধতি চালু করে।

সাধারণ বীমার আওতায় সড়ক দুর্ঘটনাজনিত বীমার প্রিমিয়াম বাবদ প্রতি বছর প্রতিটি যানবাহন থেকে ১২০০ থেকে ২২০০ টাকা আদায় করা হয়।

সড়ক পরিবহন সমিতি, ট্রাক মালিক সমিতি ও বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশের ৬৫ হাজার ট্রাক থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ৮২ হাজার বাস-মিনিবাসসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আদায় করা হয়।

এর পাশাপাশি আছে দেড় লক্ষাধিক মটর সাইকেল। একেকটি মটর সাইকেলের বার্ষিক বীমা প্রিমিয়াম দেড়শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা পর্যন্ত আদায় করে নেওয়া হয়।

এ হিসাবে প্রতি বছর আরও তিন কোটি টাকা প্রিমিয়াম জমা হয় বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে।

এ হিসাবে গত দুই যুগে এসব বাস-মিনিবাস ও ট্রাক থেকেই বীমার প্রিমিয়াম বাবদ আদায় হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

এদিকে বিআরটিএ’র হিসাবে সারাদেশে ‘সড়ক দুর্ঘটনাজনিত বীমা’ বাবদ আদায় করা প্রিমিয়ামের পরিমাণ সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা বলে জানানো হয়েছে।

কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা নিজেদের কোষাগারে নিচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্রহীতারা সেবা পাচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা যে কারণে বীমা সুবিধাবঞ্চিত হন-

 দশটি কঠিন শর্ত  

বীমা সুবিধা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও আহতদের ১০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে। অথচ বিভিন্ন বীমা কোম্পানি নানা অজুহাত দেখিয়ে এ সুবিধা দিতে টালবাহানা করে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, বীমা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর ১০টি কঠিন ও জটিল শর্ত রয়েছে।

বীমা কোম্পানীগুলো গাড়ির ক্রটি-বিচ্যুতি, ফিটনেস সার্টিফিকেট পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চালকের লাইসেন্সের জাল-ভুয়া, হতাহতের পোস্টমটেম রিপোর্ট, পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদনসহ ১০ টি জটিল সনদপত্র চেয়ে বসে। এছাড়া গাড়ি মালিক অথবা চালকের যে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় বর্তানো হয় হতাহত ব্যক্তির মাথায়।

সামান্য দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারলেই বীমা কোম্পনিগুলো সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত যাত্রীর পরিবার ও আহতদের বীমা সুবিধার ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে।

দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, অসংখ্য কঠিন শর্ত পূরণ আর জটিলতা পেরিয়ে কোনও দাবিদার বীমার টাকা আদায়ে আগ্রহী হয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জীবন বীমা কর্পোরেশনের একজন ডেপুটি ম্যানেজার এসব অভিযোগ স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, সাধারণত মানুষ প্রথম থেকেই বীমার প্রতি একধরনের অনীহা দেখান।

এছাড়া মাঠ পর্যায়ে বীমা কোম্পানির একজন কর্মী  বীমা পলিসির জন্য কাউকে রাজি করান তখন ব্যক্তি এবং মাঠ কর্মীর কেউই বীমার প্রিমিয়াম সংক্রান্ত নিয়মগুলো ভালোভাবে যাচাই করে দেখেন না। পরে যখন ওই ব্যক্তি কোনও সমস্যায় বীমার টাকা দাবি করেন, তখন বীমা কোম্পানির চাহিদামাফিক তিনি প্রিমিয়াম সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে অধিকাংশ সময়েই ব্যর্থ হন।

ফলে দেখা যায় ক্ষতিপূরণের অর্থ শোধ করতে হয় না বলে বীমার টাকা পুরোটাই কোম্পানির লাভে পরিণত হয় বলে জানান তিনি।

দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বীমার অর্থ আদায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে এর পুরো সুফল ভোগ করে বীমা কোম্পনিগুলো। যানবাহন মালিকরাও গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ কোনও ক্ষতিপূরণ পান না।

বাংলাদেশ সময় ১২৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।