ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বিআরটিসি-১

কোটি টাকার ২৩ ভলভো ভাগাড়ে!

মফিজুল সাদিক ও সাঈদ শিপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৫
কোটি টাকার ২৩ ভলভো ভাগাড়ে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাজীপুর থেকে ফিরে: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের(বিআরটিসি) সমন্বিত কেন্দ্রীয় বাস মেরামত কারখানায় অবহেলা ও অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ২৩টি ভলভো বাস। রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বর বিআরটিসি ডিপোতে অকেজো হয়ে পড়ে আছে আরও ২৬টি ভলভো বাস।

সবমিলিয়ে একসঙ্গে কেনা দ্বিতল ৫০টি ভলভোর মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র একটি।

প্রতিটি ১ কোটি ৩ লাখ টাকা মূল্যের বাসগুলো প্রায় ৫২ কোটি টাকায় কেনার সময় অর্ধেক মূল্য পরিশোধিত হয়েছিল ঋণের টাকায়। যা সুদে আসলে সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থাকে পরিশোধ করতে হয়েছে।

আবার দাতা সংস্থার দেওয়া অর্থ থেকে বেচে যাওয়া প্রায় ৯ কোটি টাকাও রাখা হয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। তা সত্ত্বেও রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভলভোগুলো।

গাজীপুরের নাগোরপাড়ায় প্রায় ১০ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা বিআরটিসি’র মেরামত কারখানাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ২৩টি ভলভো, যেগুলোর মোট মূল্য মোট ২৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফলে কারখানাটি এখন যেন মূল্যবান ভলভোর ভাগাড়।

কারখানাটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ভলভোগুলোর নিচের অংশে লতাপাতা ও আগাছা এবং ওপরের অংশ বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতিতে অল্প সময়ের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেছে এক সময়কার নগরবাসীর সাধের বিলাসবহুল বাসগুলো। কোনোটির মূল্যবান যন্ত্রাংশ খোঁয়া গেছে, আবার ভেতরে সাপও বাসা বেধেছে কোনোটিতে।

কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ ওমর ফারুক জানান, তাদের একজন সম্প্রতি গোখরা সাপের কামড় খাওয়া থেকে বেঁচে গেছেন।

কারখানা সূত্র জানায়, মোট ৫৬টি বাস এখানে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার মধ্যে ২৩টি ভলভো। বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে ১০টি মিনিবাস, তিনটি ভারতের আশোক লিল্যান্ড দ্বিতল বাস, ১৬টা চীনের তৈরি বাস এবং চারটি বিআরটিসি’র বাস।

এদিকে গাজীপুর সংস্কার কারখানায় ওই ২৩টি ছাড়াও মিরপুর-১২ নম্বর বিআরটিসি ডিপোতে অকেজো হয়ে পড়ে আছে আরও ২৬টি ভলভো বাস। একসঙ্গে কেনা ৫০টি ভলভোর মধ্যে বাকি একটি বাস মিরপুর থেকে হাইকোর্ট এলাকা পর্যন্ত চলাচল করে।

সরেজমিনে জানা গেছে, প্রতিটি ভলভো দ্বিতল বাসে মোট আসন সংখ্যা ১২০টি। বিরাট আকৃতির বাসগুলোতে অতিরিক্ত আরও ৪০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন। ফলে একটি ভলভো বাস পাঁচটি মিনিবাসের সমান যাত্রী বহন করতে সক্ষম।
 
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৯ সালে ভলভো বাস কেনার প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতিটি বাস এক কোটি তিন লাখ টাকা করে কেনার পরিকল্পনা করা হয়। ৫০টি বাস কেনায় ব্যয় হয় প্রায় ৫২ কোটি টাকা।
 
অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিডা) ৬১ কোটি  অর্থায়ন করে। এর মধ্যে সিডা ৩০ দশমিক ৫ কোটি টাকা ঋণ দেয় এবং ৩০ দশমিক ৫ কোটি অনুদান দেয়। ৫০টি বাস কেনারও পরও বাকি ৯ কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অতিরিক্ত রাখা হয়।

অথচ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, অতিরিক্ত ৯ কোটি টাকা দিয়ে বাসের নতুন সরঞ্জাম কেনা তো দূরের কথা, বরং মূল্যবান সরঞ্জাম ভলভো বাস থেকে খুলে বিক্রি করা হয়েছে।
 
জাপানি প্রযুক্তির অত্যাধুনিক মেরামত কারখানাটিতে খুব সহজেই বাসগুলো মেরামত করে নাগরিক সেবায় ব্যবহার করা যায় বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানা সূত্র।
 
সূত্রটি জানায়, প্রতিটি ভলভো মেরামত বাবদ খরচ হবে ৪০ থেকে ৪২ লাখ টাকা। ফলে ৪৯টি ভলভো বাস মেরামতে মোট খরচ হবে ২০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। টাকা হাতে পেলেই ভলভোগুলো মেরামত করা হবে।
 
গাজীপুরে সংস্থার মেরামত কারখানার এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ৫০টি ভলভোর মধ্যে ৪৯টিই অচল হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে আমাদের কারখানায় আছে ২৩টি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, ৪১ থেকে ৪২ লাখ টাকা করে খরচ করলে ভলভোগুলো আবারও চালু করা সম্ভব।

তিনি বলেন, সুইডেন থেকে আমদানি করা বাসগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। কিন্তু নষ্ট হওয়ার পর সেগুলোর যন্ত্রাংশ সময়মতো লাগানো হয়নি। ফলে ব্যবহারের ৮ বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাসগুলো। কোটি টাকার বাসগুলোর এ হালের জন্য সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণকেও দায়ী করেন তিনি।

সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বছরে প্রতিটি বাস ছয় হাজার কিলোমিটার চালানো ও সাত লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বাসে বছরে যাত্রী পরিবহন করা হয় তিন লাখ ১৪ হাজার ৮০০ জন।
 
সূত্রের অভিযোগ, ভলভো বাসগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত ৯ কোটি টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। যে কারণে অকালেই অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল হারায় সেগুলো। ২০০৪ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ভালো ছিল। সে সময় পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার চলেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, ভলভো বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ১৫ বছর পর্যন্ত ধরা হয়। তবে সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে এসব বাস অনায়াসে ২০ বছর পর্যন্ত চলাচলের উপযোগী থাকে। অথচ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, সময়মতো ইঞ্জিন তেল ও মবিল না দেওয়াসহ চুরি, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এসব কোটি টাকার ভলভো বাস অকালে বিকল হয়ে গেছে।

পরিত্যক্ত ২৩টি বাস প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, অবহেলায় জনগণের মূল্যবান সম্পদগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো। সরকারি ছত্রছায়ায় থাকা কিছু সুবিধাভোগী বাসগুলোকে নষ্ট করেছেন। জনগণকে সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের টাকা পানিতে ফেলেছেন তারা। সঠিকভাবে মেরামত করা হলে জনগণের সেবায় আরও ২৫ থেকে ৩০ বছর ভলভোগুলো সার্ভিস দিতে পারতো। কিন্তু অবহেলায় অকালেই বিকল হয়ে পড়ে বাসগুলো।
 
প্রতিটা বাস মেরামতে ৪২ লাখ টাকা খরচ করতে চায় বিআরটিসি- এটা কতোটা যৌক্তিক?, এমন প্রশ্নের জবাবে এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, আমি এটা সমর্থন করি না। কারণ, সরকার প্রতিটি বাসের জন্য ৪২ লাখ টাকা খরচ করলে কয়েকদিন পর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কোনো বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাসগুলো মেরামত করা যেতে পারে। এতে করে সঠিক সেবা পাবে জনগণ। তা না হলে আবারও মেরামতের নামে লুটপাট চলবে। সরকারি ছত্রছায়ায় আবারও জনগণের সম্পদ নষ্ট করবেন ওইসব ব্যক্তিরাই।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫ ১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৫
এমআইএস/এএসএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।