ঢাকা: সাভার চামড়া (ট্যানারি) শিল্পনগরীতে অবশেষে চালু হলো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি)। এর মধ্যে দিয়ে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে শিল্পনগরীটি।
শনিবার (৩০ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাভার শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের চারটি মডিউলের মধ্যে দু’টির কাজ শেষ করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়।
চামড়ায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল নষ্ট করার জন্য ৪টি মডিউলে ৮টি অক্সিডাইজেশন ডিস্ক থাকবে। কেমিক্যাল ও বর্জ্য পৃথক হবে এসব ডিস্কের মাধ্যমে। চারপাশে উঁচু দেয়াল, মাঝে পুকুরের মতো করে তৈরি এসব অক্সিডাইজেশন ডিস্ক। ট্যানারি থেকে বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে এসে কয়েকটি প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করবে অক্সিডাইজেশন ডিস্কগুলো।
ট্যানারি বর্জ্য প্রথমে পাইপলাইনের মাধ্যমে যাবে ব্রাইটেক্স চেম্বারে। সেখান থেকে রিফাইন হয়ে সলিট চেম্বারে যাবে। এরপর ইকুলাইজেশন ট্যাংক থেকে যাবে অক্সিডাইজেশন বক্সে ‘এ’। এরপর অক্সিডাইজেশন বক্স ‘বি’ হয়ে যাবে স্ল্যাম রিয়েল ট্যাংকে। সবশেষে বর্জ্য যাবে ডাম্পিং মেশিনে। বিষমুক্ত তরল চলে যাবে ধলেশ্বরী নদীতে। আর ডাম্পিং এর বর্জ্য দিয়ে তৈরি হবে বিদ্যুৎ।
সাভার চামড়া শিল্পনগরীর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে যে বিদ্যুৎ খরচ হবে, তা নিজস্ব পাওয়ার স্টেশন থেকেই মেটানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এজন্য ৪০ মেগাওয়াটের পাওয়ার স্টেশন প্রস্তুত রয়েছে।
চারটি মডিউলের মধ্যে অক্সিডাইজেশন ডিস্ক এ-১, এ-২ ও বি-৩, বি-৪ এর কনস্ট্রাকশন কাজ শেষ করে বসানো হয় মেশিনারি যন্ত্রপাতি।
চীন থেকে আমদানি করা পাম্প, প্যাডেল সিস্টেম পাম্প, ডিটক্সাইড ব্লোয়ার (যা দিয়ে বাতাস দেওয়া হয়) এবং ছাকনি বা স্প্রিনিং মেশিনও বসানো হয়েছে।
চারটি মডিউলের মধ্যে চালু হতে যাওয়া দুই মডিউলেরই প্রতিদিন ১২ হাজার ৫০০ কিউবিক মিটার বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। বাকি দুই মডিউল চালু হলে ২৫ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা অর্জন করবে সিইটিপি।
সিইটিপি’র প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল কাইয়ুম বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি আসুক আর না আসুক আমাদের দুটি মডিউল আজ (শনিবার) বিকেল সাড়ে চারটায় চালু করছি। যেহেতু কোনো ট্যানারি এখনো আসেনি, সেহেতু নদীর পানি দিয়েই আমাদের ট্রায়াল দিতে হচ্ছে। রাতের মধ্যে নদীর পানি নিয়ে দেখা হবে, ঠিকমতো সব কাজ হচ্ছে কি-না।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কোনো ট্যানারি বর্জ্য উৎপাদন করলে আমাদের পরিশোধন করবার সক্ষতা রয়েছে। তবে যেহেতু ট্যানারি নেই, তাই পানি দিয়েই ট্রায়াল দিচ্ছি।
বাকি দু’টি মডিউল মার্চের মধ্যেই শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফিনিশড্ লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন মাহমুদ মাহিন বাংলানিউজকে বলেন, ঠিক জানি না, তারা সিইটিপি চালু করেছেন কি-না? তবে আমাদের এই মুহূর্তে কোনো ট্যানারি সেখানে স্থানান্তরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ট্যানারি যেতে যেতে আরো দুই এক মাস লেগে যাবে।
ট্যানারি মালিকদের অন্য সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি জানি না, চালু করেছেন কি-না? তবে সম্ভবত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু করেছেন, সিইটিপি না।
তিনি বলেন, সিইটিপি চালু করলেও এপ্রিলের আগে কোনো ট্যানারির পক্ষে সেখানে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে না।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ট্যানারি বর্জ্য না পেলেও সিইটিপি চালু রাখতে হলে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হবে। যা ভর্তুকি হিসেবেই দিতে হবে সরকারকে।
গত ১০ জানুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ১৫৫টি ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ট্যানারিও সেখানে স্থানান্তরিত হয়নি।
এরপর ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ১৪২টির বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, কেন তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাভারে যেতে পারবে না? ট্যানারি মালিকদের মধ্যে অধিকাংশই ওই নোটিশের জবাবে সময় চেয়েছেন বলে জানা গেছে। অনেকে আবার সাভারে যাওয়ার জন্য সেখানে কাজও শুরু করেছেন। তবে সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীতে উৎপাদনে যেতে আরো দুই থেকে ৩ মাস লেগে যেতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সাভারের বলিয়াপুর ইউনিয়নের হরিণ ধরায় নদী তীরে ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমিতে পরিবেশবান্ধব এ চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
সেখানে বিএফএলএলএফইএ’র আওতাধীন ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের অনুকূলে ২০৫টি প্লট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। ওই ১৫৫ ট্যানারি কারখানা স্থানান্তরিত হবে হাজারীবাগ থেকে।
জনস্বাস্থ্যের কারণে ২০০৩ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পনগরী অপেক্ষাকৃত কম জনবসতি এলাকা সাভারে স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা করে সরকার। ওই বছরের ১৬ আগস্ট একনেকে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনকালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৭৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বেড়েছে। বর্তমানে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুন মাসে।
শিল্পনগরীর সাড়ে ১৭ একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে সিইটিপি। সিইটিপি নির্মাণের কাজ করছে চীনের জেএলইপিসিএল-ডিসিএলজেভি লিমিডেট।
** মন্ত্রীর আল্টিমেটাম সরাতে পারেনি একটি ট্যানারিও!
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
এসএম/এএসআর