চট্টগ্রাম: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে খেলাপিঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জোদ্দার।
বাংলানিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় পরিচর্যা ও নজরদারির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ায় এবং শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা সচেতন হওয়ায় খেলাপির হার কমছে। ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছেন শুধু পণ্য আমদানি করলেই হবে না, বিশ্ববাজারের গতিপ্রকৃতি, অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা-জোগান ইত্যাদি বিষয়ে দূরদর্শিতা থাকলেই মুনাফা অর্জন ও ব্যাংকের দেনা সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব। চট্টগ্রামের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে আমরা আশাবাদী।
আগামী দুই বছরের মধ্যে খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াবেন আশা প্রকাশ করে মিজানুর রহমান জোদ্দার বলেন, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ঢেউয়ের মতো উঠানামা করে। অর্থনীতিতে ঢেউ থাকবেই। যে অর্থনীতিতে ঢেউ নেই সেটি স্থবির, নিষ্প্রাণ। এটা নাড়ির স্পন্দনের মতো। যাকে আমরা বলি সুইং। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো শক্তিশালী মুদ্রানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের দেখভালের মাধ্যমে অর্থনীতির ঢেউ কতটা ফ্ল্যাট (স্থিতিশীল) করা যায়। এর সঙ্গে মৌসুম, আন্তর্জাতিক বিষয়-আশয় জড়িত, বিশ্বটাই এখন গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে। আমরা সৌভাগ্যবান বিশ্বমন্দার আঁচ লাগেনি।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে নির্বাহী পরিচালকের পদটি সৃষ্টি করা হয়েছে। এর সুফল তারা পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে মিজানুর রহমান জোদ্দার বলেন, অবশ্যই পাচ্ছেন। চট্টগ্রামের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সমস্যার সিংহভাগই আমরা সমাধান দিয়ে দিচ্ছি। কোনো বিষয়ে যদি গভর্নর মহোদয়ের মতামত-অনুমোদন প্রয়োজন হয় তবে সে ফাইলটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমি ৩২ বছরের চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকভাবে নিজ নিজ কাজ সম্পাদনে প্রেরণা দিচ্ছি। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ইত্যাদির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি সেবা দিতে পারছি আমরা।
আগামী কয়েক বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী কয়েক বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ বা বাণিজ্যিক প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হবে। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ, মিরসরাই ও আনোয়ারায় স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের আয়তন ও কর্মপরিধি বাড়ানো, বে টার্মিনাল, টাইগারপাস থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং পর্যটন খাতে ও ব্লু ইকোনমির উজ্জ্বল সম্ভাবনা তো থাকছেই। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ট্রানজিট। ভারতের সেভেন সিস্টার, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারের পণ্য পরিবহন। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকটার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) আসছে। বাংলাদেশ চীন ভারত মিয়ানমার (বিসিআইএম) করিডোর হলে কুনমিং পর্যন্ত আঞ্চলিক সংযোগ সম্প্রসারিত হবে। এসবই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে অর্থনীতিতে।
এই বিশাল কর্মপরিকল্পনার মূল চালিকা-শক্তি অর্থ। এর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে মিজানুর রহমান জোদ্দার বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুধু নয়, রূপকল্প ২০২১ সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাপক সংস্কার ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয় হলো চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। মূলত ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিই এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর গভর্নর মহোদয় হিউম্যান রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট নামের প্রতিষ্ঠানটির শীলান্যাস (ভিত্তিস্থাপন) করেছেন। অলাভজনক এ ইনস্টিটিউটে একটি মাল্টিপারপাস হল, একটি থিয়েটার টাইপ কনফারেন্স হল, দুটি বড় ও ছয়টি ছোট কনফারেন্স রুম থাকবে। এ ছাড়া ২০টি শ্রেণিকক্ষ, দুটি লেকচার থিয়েটার, কর্মীদের জন্য কিউবিক্যাল ওয়ার্ক স্টেশন, ৬৭টি ডাবল বেড ও ৩২টি সিঙ্গেল বেডের হোস্টেল রুম, ২৬টি স্যুট, ৮টি ফ্যামিলি কটেজ, ২টি এক্সিকিউটিভ অ্যাপার্টমেন্ট ও স্টাফদের জন্য একটি ডরমিটরি থাকবে। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের নেতৃত্ব তৈরির এ কেন্দ্রে কম্পিউটার সেন্টার, অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার, লাইব্রেরি, কিচেন, ডাইনিং, বাংলা একাডেমির মতো স্থায়ী ও অস্থায়ী এক্সিবিশন এরিয়া, স্টাডি গ্যালারি, খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, মসজিদ, পর্যাপ্ত কার পার্কিং ব্যবস্থা থাকবে। আশাকরি, ২০১৯ সালের মধ্যে এ ইনস্টিটিউট তৈরি হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এ ইনস্টিটিউট হয়ে গেলে ব্যাংকিং খাতে গুণগত ও পরিমাণগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটবে। এখন যেভাবে ব্যাংকারদের ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে প্রশিক্ষণের জন্য তখন তার প্রয়োজন হবে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রশিক্ষকেরা এ ইনস্টিটিউটে এসে প্রশিক্ষণ দেবেন, কোর্স করাবেন। বিদেশি ব্যাংকাররাও আসবেন প্রশিক্ষণ নিতে। ইতিমধ্যে সিডিএর অনুমোদনসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। শিগগির নির্মাণকাজ শুরু হবে আশাকরি।
আগামী মার্চে চট্টগ্রামে ব্যাংকিং মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে নির্বাহী পরিচালক বলেন, আপনারা জানেন ঢাকায় সফল একটি ব্যাংকিং মেলা হয়েছে। চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলোও তাদের সেবা, প্রডাক্ট সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে অনুরূপ মেলা চায়। এ ব্যাপারে আমরা প্রধান কার্যালয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। আশাকরি, মার্চে একটি ব্যাংকিং মেলা করতে পারবো।
নগর ভবন, আয়কর ভবন, পোর্ট টাওয়ারের মতো চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইকনিক ভবন তৈরির পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত ভবনের প্রধান ফটক ও সিডিএ ভবনের মাঝে আমাদের পুরোনো ভবনটি ভেঙে ১৫ তলার একটি দৃষ্টিনন্দন আইকনিক টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
এআর/আইএসএ/টিসি