ঢাকা: ইলিশের অভয়াশ্রম গড়ে তুলে জাটকা মাছ রক্ষার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মার্চ-এপ্রিল মাসে পদ্মা-মেঘনা নদীর প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু ইলিশ মাছ ধরে যেসব জেলে জীবিকা অর্জন করেন, তারা যেন সমস্যায় না পড়েন- সে লক্ষ্যে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৫২ জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এর মোট পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। এছাড়া জেলে পরিবারকে স্বল্প সুদে ঋণ, সেলাই মেশিন ও আয়বর্ধক নানা কাজে উৎসাহী করা হয়েছে। বিশেষ করে ইলিশ ধরেন- এমন জেলেদেরকে নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
এসব উদ্যোগের কারণে ইলিশ উৎপাদনে সফল হয়েছে সরকার।
যেখানে ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৯১ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে বর্তমানে বছরে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন করা হচ্ছে। আর আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ টন ইলিশ উৎপাদনের নতুন মাইলফলক স্থাপিত হবে বলে জানান ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষকেরা।
ওয়ার্ল্ড ফিশের টিম লিডার আব্দুল ওহাব বাংলানিউজকে বলেন, নানা পদক্ষেপের কারণে ইলিশের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বছরে প্রায় ৪ লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদনের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করবে। আমরা আশা করছি, উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ইলিশকে সার্বজনীন করতে চাই। শুধু বৈশাখ মাস কেন, আমরা সব সময় ইলিশ মাছ খেতে চাই। দেশে ইলিশ কেউ খাবে, কেউ খাবে না তা হবে না। সবাই যেন সস্তায় ইলিশ খেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করে ছাড়বো’।
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ও বঙ্গোপসাগরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইলিশ ধরা পড়েছিল দুই লাখ টন। ২০০২ সালের পরে ইলিশ উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল ওহাব বলেন, সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইলিশ বাইরে চড়া দামে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, মালয়েশিয়া ও আমাদের প্রতিবেশী দেশে ইলিশ পাচার হচ্ছে’।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের কাছে রোল মডেল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ। কারণ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ আসে ঝকঝকে রুপালি ইলিশ থেকে। এছাড়া ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ মাছের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন বাড়ায় অর্থনৈতিক পরিধিও বাড়ছে।
মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘দেশের সকল মানুষের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ইলিশ মাছ সংরক্ষণেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইলিশ মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের জীবিকা নির্বাহে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলে পরিবারকে চাল দিচ্ছি। সেলাই মেশিন, গরু, ছাগল ও ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে জেলে পরিবারের মাঝে’।
‘এর পরও যদি কোনো জেলে আইন অমান্য করেন, তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় আমরা অাইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। কারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল যন্ত্র ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে ইলিশ মাছের উৎপাদন’।
ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ২০ শতাংশ, মায়ানমারে ১৫ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ৫ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে।
ভারতের মৎস্য বিভাগের হিসাবে, ২০১১ সালে সে দেশে ইলিশ ধরা পড়েছিল ৮০ হাজার টন। ২০১৪ সালে তা নেমে এসেছে ১৪ হাজার টনে। তবে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে।
ভারতে ইলিশ মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ভারতের প্রধান ইলিশ ব্যবস্থাপক ড. উৎপল ভৌমিক জানান, ‘হুগলি ও ভাগিরথি নদীর অববাহিকায় ইলিশ মাছের উৎপাদন প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইলিশ মাছ রক্ষায় তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমাদের কাছে তথ্য আছে ৭৫ শতাংশ ইলিশ ০ দশমিক ৫ গ্রাম ওজন হওয়ার আগেই ধরে ফেলা হয়’।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডিজের(বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. এ আতিক রহমান বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু আগামী ১০ বছর পর এই ধারা আর থাকবে না। এর মধ্যে অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এতে করে ইলিশের ঝাঁক মায়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে।
‘এছাড়া নদী দূষণ ও বাঁধ নির্মাণের কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে আসবে। ইলিশের ধারাবাহিক উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে আমরা যে সব পলিসি নিয়েছি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে ইলিশ মাছ মেঘনা নদীতে না এসে মায়ানমারে চলে যাবে’।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর