ঢাকা: শেষ সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফুট সড়কের অস্থায়ী গরুর হাট। এ হাটে বেপারীদের সংখ্যা হাতে গোনা।
তাদের মধ্যে একজন কুষ্টিয়া সদরের মাছপাড়া গ্রামের চাষি হোসেন আলী। মাঝারি লাল একটি গরু হাটে নিয়ে এসেছেন হোসেন।
তিন বছর বয়সী গরুর মাংস পাওয়া যাবে পাঁচ মণ। দাম হাঁকা হচ্ছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে এখনও ৮০ হাজার টাকার বেশি দাম ওঠেনি। মাত্র একটা গরুই দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ৩শ’ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এ হাটে এসেছেন হোসেন।
ছোটবেলা থেকেই গরুর সঙ্গে সখ্যতা তার। হোসেনের গরুটি দেখতে মোটা তাজা ও সুন্দর গরু। নিজ বাড়িতে লালন-পালন করা গরু। কৃষক পরিবারে বিচালি, গাছের পাতা, মাঠের ঘাস, ভাতের মাড় খেয়ে মোটা-তাজা করা হয়েছে। শুক্কুর আলী নামকরণও করা হয় হয়েছে লাল গরুটির। কারণ এর জন্ম শুক্রবারে।
মূলত হোসেনের স্ত্রী বেমালা খাতুনের ওপর ছিল শুক্কুর আলীর সমস্ত দায়িত্ব। খাবার, গোসল থেকে শুরু করে সকল পরিচর্যা করেছেন বেমালা। যে কারণে হাতে পোষা আদরের গরুটিকে বিদায় দিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন বেমালা।
হোসেন আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার ফেমিলি (স্ত্রী বেমালা) শুক্কুর আলীকে (গরু) খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব করছে। আমি চাষি মানুষ, মাঠে খাটি। বাড়ির গরু পালার কাজ আমার ফেমিলি করচে। বাড়ি থি (থেকে) গরু বের করার সুম (সময়) ফেমিলি অনেক কাইদিচে (কান্না)। ফেমিলি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুক মুইচে দিয়ে দোয়া করচে। শুক্কুরিরে টাকে (ট্র্যাক) তোলার পর থেকেই ফেমিলি কান্না করচে। গরু যকন (যখন) বাসা থি আনিচি অনেক পর্যন্ত চেয়ে দেকেচে আমার ফেমিলি। আমার থি স্ত্রীর মায়া একটু বেশি। গরুর মায়ের (গাভী) দুধ খাইনি, শুক্কুর যাতে (গরু) আর মোটা-তাজা হয়’।
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ির সগলের (সকর) মন খারাপ। শুক্কুরের জন্যি অনেক মায়া। আমরা গরিব মানুষ, জমি জিরিত (জমি-জায়গা) নি। গরিবের গরুর উপরে মায়া থাকতে নি’।
হোসেন আলীর মতো একটা গরু হাটে নিয়ে এসেছেন কুষ্টিয়ার আব্দুল রাজ্জাক। চার মণ মাংস পাওয়া যাবে এমন গরুর দাম হাঁকছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
গরুটি নিজ হাতে পালন করেছেন রাজ্জাকও। একটি গরুর জন্য দীর্ঘ পথ পাড়িসহ সমস্ত কষ্ট মাথায় নিয়ে হাটে পড়ে আছেন তিনি।
ঠিক মতো খাওয়া, ঘুম ও গোসল নেই। শুধু ভাতের সঙ্গে আলু ও বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে দিন পার করছেন এসব মানুষেরা। তারপরও পোষা গরুটি একটু ভালো দামে বিক্রি করতে পারলেই খুশি রাজ্জাক। একটি ট্রাকে ১০ জন বাড়ির পালা গরু হাটে তুলেছেন।
মাত্র একটি গরু হাটে আনা প্রসঙ্গে আব্দুল রাজ্জাক বাংলানিউজকে বলেন, ‘গরিব মানুষ! গরুডি হাতে পালছি তিন বছর। দুইডি ট্যাকা বেশি পাবো ভাইবেই ঢাকায় নিয়ে আইচি। গিরামে (গ্রাম) গরুর তেমন নি। কেউ ৫০ (হাজার) কই ৬০ কই। ঢাকায় মনে হচ্ছে দুইডি ট্যাকা বেশি হবেনি (হওয়া)’।
আরেক চাষি নাটোরের গুরুদাশপুরের কালু মিয়া (৭৫)। বয়স বেশি হলেও মনের জোরে এখনও কমেনি। বাড়ির পালা তিনটা গরু নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন তিনি। শৈশব থেকেই গরু পালছেন কালু মিয়া।
ঢাকার হাটে গরু বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুইড পয়সা বেশি পাওয়ার নেইগি গরু আইনেচি। আমরা গিরস্তো মানুষ। সব সময় আমাদের বাড়িতি গরু থাকে। এখনই দুইডি গাভীর বাচ্চা আছে। দুইটি গাভী দুধও দেই। পরের বার আর চারটি গরু বিককির করা যাবে। আমরা চাষি মানুষ, গরুই আমাদের সম্বল’।
পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফুট সড়কের পাশের গরুর হাটে সবারই দেশি ও বাড়ির পালা গরু। এখানে বেপারীর সংখ্যাও কম। অধিকাংশ চাষি পরম মমতায় বড় করে তুলেছেন এসব গরু। যে কারণে বিক্রির পরে আদরের পশুটিকে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে তুলে দিচ্ছেন ক্রেতাদের হাতে। আদরের গরুটিকে ক্রেতার হাতে তুলে দিয়ে অনেক চাষিও ফেলছেন চোখের জল।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬
এমআইএস/এএটি/এএসআর