ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বিরান চরে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প শহর

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
বিরান চরে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প শহর চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম

মিরসরাই-সোনাগাজী থেকে ফিরে: কয়েক বছর আগেও ছিলো বিরানভূমি। জনমানব শূন্য নদীর কোলঘেঁষে জেগে ওঠা চরগুলো ছিলো সবুজ ঘাসে মোড়ানো নীরব নিস্তব্ধ মাঠ। কিন্তু এখন আর সেই চিত্র নেই। সেই চরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। নিঝুম চর ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সরব। এখানেই গড়ে উঠছে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প শহর।

বলছি চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর বিশেষ ইকোনোমিক জোনের কথা।

সম্প্রতি এ ইকোনোমিক জোনে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে।

এসময় তারা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে এ প্রকল্পের বিনিয়োগ বিষয়ক সেমিনারে অংশ নেন। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান।

এ বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ফেনীর সোনাগাজী আর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গড়ে উঠছে দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ ইকোনোমিক জোন। এই প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগকে উদ্বুব্ধ করতে চীনের তিনটি প্রদেশে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারগুলো অত্যন্ত সফল হয়েছে। বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
বিশেষ ইকোনমিক জোন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাল্টাতে শুরু করেছে মিরসরাই ও সোনাগাজী উপজেলার চরাঞ্চলের চেহারা। সবুজ চর পরিণত হয়েছে ব্যস্ত জনপদে। মাটি কাটা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্টসহ যাবতীয় অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে শত শত শ্রমিক।

কাজ পেয়ে জীবন পাল্টাতে শুরু করেছে এখানকার অনেক বেকারের। বেজা সূত্রে জানা যায়, এ ইকোনোমিক জোনে কর্মসংস্থান হবে ২৫ লাখেরও বেশি মানুষের।

২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেন। বেজা সূত্র জানায়, সম্প্রতি চীনা কোম্পানি ‘জিনডোন’ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী চীনা কোম্পানির আড়াই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
এদিকে ভারত এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ হাজার ৫৫ একর জমি চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে বলেও জানিয়েছে বেজা। জানা যায়, ভারতকে জমি দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে এ নিয়ে চুক্তি হতে পারে। সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি ভারত চিঠিতে মিরসরাইয়ে সম্ভাব্য জমিও চিহ্নিত করেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি দেশীয় বড় বড় কোম্পানি আশপাশে জমি কিনছে। এতে সেখানকার জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এতে খুশি জমির মালিকেরাও।

প্রকল্পে কর্মরত এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিগ্রহণ করা জমিতে এখন চলছে ভূমি উন্নয়ন, এলাকায় যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ, সুপেয় পানি সরবরাহ ও বাঁধ নির্মাণের কাজ। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। মিরসরাইয়ের মঘাদিয়া থেকে প্রকল্প এলাকায় যাওয়ার জন্য ছয় কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের কাজও প্রায় শেষের দিকে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
চার লেন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজও এগিয়ে চলেছে। চর জেগে ওঠার কারণে সেখানকার জমি অনেক নিচু। তাই জমি উঁচু করতে এখন সেখানে ফেলা হচ্ছে মাটি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ছুটে যাচ্ছেন।
 
বেজা সূত্রে জানা যায়, এখানে মোট ৭ হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকারের ভরাট করা জমিতে প্লট নির্মাণ, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ গ্যাস ও বর্জ্য নিরসনের ব্যবস্থা করবে ডেভেলপার। বেজা ৫০ বছরের জন্য প্রাইভেট ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে জমি লিজ দেবে।
 
প্রাথমিকভাবে ৫শ ৫০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে টেন্ডারের মাধ্যমে সেখানে যোগাযোগের জন্য পাকা সড়ক নির্মাণ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। বাঁধে থাকছে স্লুইস গেট কাম সেতু। এই কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২২ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০১ টাকা।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
এ ছাড়া অর্থনৈতিক জোনের অধিভুক্ত জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। ২২ কোটি ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক,   ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) ও সরকারি অর্থায়নে এসব কাজ করছে মেসার্স আতাউর রহমান খান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এ অর্থনৈতিক জোনে ১৫ হাজার একর খাস জমিতে ৫০টি উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বেজার।

ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৩৯০ একর বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৯ হাজার একর জমি আগামী দুই বছরের মধ্যে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। হস্তান্তর করা ৬ হাজার ৩৯০ একর জমির মধ্যে পীরের চরের ১৩শ ৯০ দশমিক ৩১৬ একর, সাধুর চরের ১৬শ ৪৪ দশমিক ১ হাজার ৩৯ একর, শিল্প চরের ১৮শ ৫২ দশমিক ৫ হাজার ৩৮৫ একর এবং চর মোশারফের ১৫শ ০৪ দশমিক ২৯৩০ একর জমি সর্বমোট ছয় হাজার ৩৯০ একর জমি প্রথম ধাপের কর্মপরিকল্পনায় রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
পরে মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ৩০ হাজার একর জায়গাকে অর্থনৈতিক জোনে মিলিত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পশ্চিমে জেগে ওঠা নাছরিন চরকে খুঁটির বাইরে রাখা হয়েছে। এটি ফেনীর অর্থনৈতিক জোনের আওতায় রেখে মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনের সঙ্গে মিলিত করা হবে।
 
জানা যায়, তৈরি পোশাক ও পোশাক খাত শিল্প, মোটরবাইক নির্মাণ ও অটো মোবাইল পার্টস, স্টিলসহ মেশিনারিজ নির্মাণের লক্ষ্যে মোট ১ হাজার ২২২টি কারখানা স্থাপন করা হবে এ ইকোনোমিক জোনে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
এছাড়াও এখানে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এলাকা, সমুদ্রবন্দর, কম্পোজিট প্ল্যান্ট, আইটি পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, বিকল্প পোর্ট কানেকটিং সড়ক, রেললাইন, সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট ও দুইটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো. আবুল কালাম আজাদ সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৮ সাল থেকে যাতে শিল্প উৎপাদন হয় সে লক্ষ্যে নির্বাচিত ডেভেলপার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
চট্টগ্রামের সিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর স্পেশাল ইকোনোমিক জোনে চলছে কর্মযজ্ঞ- ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
সূত্রে জানা যায়, শুরুতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় এলাকাকে বিবেচনায় আনা হলেও পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা নতুন চরও যুক্ত করা হয়। ফেনীর সোনাগাজীর দক্ষিণে উপকূলীয় এলাকায় প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু হয়েছে।
 
মিরসরাই-সোনাগাজী অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বাস্তবায়িত হলে শুধু এ অঞ্চল নয় পুরো দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
এসএইচডি/আরআর/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।