এসব কিছু বিবেচনা করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য এক প্রকার সর্তক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বুধবার (২৬ জুলাই) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রবণতার মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে অর্থবছরের প্রথম ভাগের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো।
দেশের উত্তর পূর্ব হাওর ও সিলেট অঞ্চলে বন্যার কারণে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। এতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে।
তবে শেষের ছয়মাস নাগাদ তা কিছুটা বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। যদিও গত মূদ্রানীতিতে ঘোষিত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কমে মে পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১৬ শতাংশ। এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার কোন ঋণ নিচ্ছে না উল্টো পরিশোধ করছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঋণের যোগান দেওয়ার মাধ্যমে দেশে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে। গত মূদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ; লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট। তবে অর্থবছরের শেষার্ধে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ কম যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ব্যাপক মূদ্রার সরবারহ (এম২) বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১৫ শতাংশ থেকে প্রায় ৩ শতাংশ কমিয়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ করা হয়েছে।
তবে অর্থবছরে শেষার্ধের ঋণ যোগান বাড়বে বলে এম২ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
মূদ্রানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে রাখা এবং ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মূদ্রানীতি অভ্যন্তরীণ ঋণ, বেসরকারি ও সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে।
ঋণ প্রবাহ কমিয়ে এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সংকোচনমূলক’ মুদ্রানীতি দিলো কিনা- এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গভর্নর বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সেটা সম্ভব। এটি স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধিমুখী মুদ্রানীতি।
সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় এর সুদহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদের ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করায় ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমছে। এতে আমানতের বিপরীতে সুদ হার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে অলস তারল্যের খরচ বিতরণকৃত ঋণ থেকে উঠাতে গিয়ে ঋণের সুদ হারও আশানুরুপ কমানো যাচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র সুদ হার মুদ্রানীতির জন্য ঝুকি উল্লেখ্য করে ফজলে কবির বলেন, নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য দুটি ঝুঁকি। একটি হচ্ছে বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিহীন উচ্চ মুনাফা হার। এটি সরকারের জন্য অতিরিক্ত সুদ ব্যয়ভার সৃষ্টি ছাড়াও বন্ড বাজারের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার বিদ্যমান বাজার সুদ হারের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী বন্ডের সর্বোচ্চ বা মেয়াদী আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হারের সামন্য বেশি নির্ধারণ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ব্যাংকের তিন বছরের চেয়ে বেশি মেয়াদী আমানতের সর্বোচ্চ সুদ হার সাড়ে ৮ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে গড়ে ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে।
রেমিটেন্সকে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের দ্বিতীয় ঝুঁকি উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, রেমিটেন্স কমে যাওয়ার জন্য উৎস দেশগুলোর ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত কঠোরতা রেমিটেন্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত দেশের বড় বড় ব্যাংক মানিলন্ডারিং ঝুকির কারণে ওই দেশের কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিপুল অঙ্কের অর্থদণ্ড দিয়েছে। ফলে রেমিটেন্স প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে ফেলছে। এটি বৈধপথে রেমিটেন্স প্রবাহ কমাচ্ছে। তবে বৈধপথে রেমিটেন্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সচেষ্ট রয়েছে।
মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়েছে, অন্যান্য খাতে ঋণ সুদ হার কমে আসায় কৃষি ঋণের সুদ হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদহার কমাতে আমানত সুদহার অন্যায্য কমানো হয়েছে। এটি না করে পরিচালন ব্যয় ও খেলাপী ঋণজনিত প্রভিশনিং ব্যয় কমিয়ে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বলা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের অর্থায়ন যেন উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হয় এজন্য নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়া নতুন বিনিয়োগকালী তৈরিতে আর্থিক ইকোসিস্টেম সৃষ্টির জন্য বলা হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং করছে। নতুন করে যাতে কোনো ঋণ খেলাপি না হয়। এজন্য সঠিকভাবে নিয়মিত মেনে ঋণ বিতরণ করতে বলা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে চেঞ্জম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, এসকে সুর চৌধুরী ও এসএম মনিরুজ্জামান, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আখতারুজ্জামান, প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৭/আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা
এসই/এমএ