বিগত বছরগুলোতে তিনটি খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও এবার শিল্পায়ন, পুঁজিবাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই কর দিয়ে বিনিয়োগ করা যাবে। এ টাকার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, মহামারিকালীন এ সংকটে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চায় সরকার। এই লক্ষ্যে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ। ফলে আগামী ২ থেকে ৫ বছর অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকতে পারে আসছে বাজেটে।
এই অর্থের উৎস নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো প্রশ্ন করবে না, এমন আভাসও পাওয়া গেছে।
গত পাঁচ বছর ধরে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগকারীরা আবাসন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে সাদা করতে সক্ষম হয়েছেন, যা নিয়মিত করদাতাদের জন্য ১০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে থাকে।
তবে তহবিলের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করার ক্ষমতা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার এখন এক্ষেত্রে পুরোপুরি ছাড় দেওয়ার উপায় খুঁজছে এবং সংকটে প্রশ্ন না রেখে বিনিয়োগ বাড়ানোর পথে হাঁটছে।
লকডাউন পরিস্থিতি ও বিক্রয় ভেস্তে যাওয়ার কারণে অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের অপারেশন গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। সরকার এদের কর্পোরেট শুল্ক ২.৫ শতাংশ কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, যাতে তারা কিছুটা স্বস্তি পায়।
২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যক্তি করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা সরকার বাড়িয়ে দিতে পারে। যাতে নিম্ন-আয়ের মানুষেরা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কষ্টকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে।
এবার করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হতে পারে।
বাজেটে আয়কর স্ল্যাবগুলি পুনরায় বিন্যাস হতে পারে। আয়করের হার এখন ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ রয়েছে। তবে পরের অর্থবছরে এটি ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কাটা হতে পারে।
ইতোমধ্যে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি আবেদনের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য কম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
রাজস্ব আহরণে ব্যাপক নিমগ্নতা এনবিআরকে উদ্বুব্ধ করেছে। তারা সরকারকে অনুরোধ করেছে, পরবর্তী অর্থবছরের জন্য একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে। সরকার আসন্ন অর্থবছরের জন্য ৩০১,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারে, যেটা শুরুতে পরিকল্পনা করা হয়েছিল ৩৩০,০০০ টাকার চেয়ে কম।
আশা করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরে এনবিআর প্রায় ২২০,০০০ কোটি টাকা লগ করবে, যা হবে ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ ঘাটতি। করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে এমন ঘটনা ঘটবে।
এনবিআরের ধারণা, এই অঙ্ক গত বছরের মোট রাজস্ব সংগ্রহ ২২৩,৮৯২ কোটি টাকার নিচে নেমে আসবে, যা কিনা অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো সংগ্রহটি আগের বছরের তুলনায় কম।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমতুল মুনিম গত মাসে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন, রাজস্ব সংগ্রহ আগামী অর্থবছরে ২৫০,০০০ কোটি টাকার বেশি হবে না। যেহেতু সংগ্রহটি হ্রাস পাচ্ছে এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে। এটি হবে পরপর নবম বছর যখন এনবিআর সরকার নির্ধারিত প্রকৃত ও সংশোধিত উভয় সংগ্রহ লক্ষ্যই মিস করবে। এটা সরকার নির্ধারণ করে তার সার্বিক আর্থিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।
চিঠিতে বলা হয়, ৩০০,৫০০ কোটি টাকার সংশোধিত সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে অর্জন করা অসম্ভব হবে, কারণ দেশীয় ও বহিরাগত চাহিদা, ব্যবসা এবং আয়ের ওপর লকডাউনের প্রভাব দীর্ঘ হয়েছে।
এই অনুমান এমন সময়ে এল, যখন এনবিআরের কর সংগ্রহ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১ শতাংশের একটু বেশি বেড়ে ১৭৫,০০০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। আর ধীরগতির সংগ্রহটি ছিল এপ্রিল মাসে নেতিবাচক বৃদ্ধির জন্য। এই নেতিবাচক বৃদ্ধি ছিল ঘাতক ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সবকিছু বন্ধ করে বাসায় থাকার নির্দেশনার প্রথম মাসের ফল।
এপ্রিলে রাজস্ব আদায় ৫৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটা তারই প্রতিফলন।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রোববার (৭ জুন) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাস্তবসম্মত আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ হবে।
দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মহামারির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে অর্থবছরের বাকি সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা যায়।
সিপিডি অর্থনীতির বিষয়ে পর্যালোচনায় বলেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব জোগাড়ের ক্ষেত্রে কোনও আশার আলো নেই। রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি চলতি অর্থবছরের সামগ্রিক কর ও আয়কর রাজস্ব ঘাটতির পূর্বাভাসকে ওপরে উন্নীত করে ১২৫,০০০ কোটি টাকায় ঠেকিয়েছে যা আগে ছিল ১০০,০০০ কোটি টাকা।
এর দ্বারা বোঝা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের গ্রোথ হবে সম্ভবত ০.৪ শতাংশ যা খুবই সামান্য। ফলস্বরূপ রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ২০১৯-২০ বছরে হ্রাস পেতে পারে, যা ২০১৮-১৯ এ ছিল ৯.৯ শতাংশ।
সিপিডি বলেছে, যদি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মতভাবে সেট করা না হয় এবং পরিস্থিতির বাস্তবতা প্রতিফলিত না করে, এটি এনবিআরের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করবে, রাজস্ব কাঠামোকে একটি সহনীয় সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার চাপ দেবে এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতি উপকরণগুলির কার্যকারিতা ক্ষুণ্ন করবে।
এটি আর্থিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেবে, আর্থিক ঘাটতির ভুল ব্যাখ্যা তৈরি করবে এবং ফলস্বরুপ আর্থিক ঘাটতির অর্থায়নের যথাযথতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
সিপিডি জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে অবশ্যই প্রস্তাবিত আর্থিক ব্যবস্থাগুলির মাধ্যমে কীভাবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে সে সম্পর্কে একটি বিশদ ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
তবে এনবিআর সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির ২ শতাংশ বা ৬.৭ বিলিয়ন ডলারের সর্বনিম্ন রাজস্ব ক্ষতি হবে বলে সরকার অনুমান করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কারণে রাজস্ব আদায়ে একটি নেতিবাচক প্রভাব থাকবে।
এসব কারণে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আসছে বাজেট বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করেন তারা। এতে করে অর্থ পাচার কমবে। বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারির কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির গতি সচল করতে সকল ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে। ’
তিনি বলেন, ‘বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হলে তা অর্থনীতির মূল স্রোতে আসবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে। এতে করে অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। ’
অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের আয়কর নীতির সাবেক জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ক্ষতি পুষিয়ে উঠতেই অনেক সময় লাগবে। রাজস্ব আয়ও কমবে। সরকারকে খরচ মেটানোর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে তার বড় উৎস হতে পারে অপ্রদর্শিত আয়। এই অর্থ বিনা প্রশ্নে এখন অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। এখন নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় নেই। প্রতিটি দেশই তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সম্ভব সব পদক্ষেপ নেবে। আগে টিকে থাকতে হবে। এ টাকা বিনিয়োগে আনতে আইনে সংশোধনী আনতে হবে। বলতে হবে, অন্য আইনে যাই থাকুক, এই বিনিয়োগের অর্থের উৎস নিয়ে দুদক বা অন্য সংস্থা প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৭ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০২০
এসএমএকে/এজে