ঢাকা: টেকনাফ উপজেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় শহরের কোনো সুযোগ সুবিধা সেখানে নেই।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষার জন্য ২০১৮ সালে শুরু হয় ‘প্রবিতেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি খুবই হতাশাজনক। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৫ কোটি ৮৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল এ বছরের জুন মাসে।
শুরু থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বা ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। দুর্গম এলাকায় জনবল না থাকায় প্রকল্পের কাজ থেমে আছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প তদারকি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
‘প্রবিতেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ওপর সংস্থাটির একক প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইএমইডি এই প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করতে সরেজমিনে যায়। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে আইএমইডি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, নানা গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা প্রতি মাসেই প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে মিটিং করি। কিন্তু করোনার কারণে গত ৪ থেকে ৫ মাস সভা বন্ধ রয়েছে। শিগগিরই সভা ডেকে প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার কারণ হলো, প্রকল্পের আওতায় জনবলের অভাব ও দুর্গম এলাকার জন্য সুপারভিশন ও মনিটারিংয়ের দুর্বলতা। প্রকল্পের আওতায় ২৫টি পদ রাখার প্রস্তাব করা হলেও অনুমোদন হয় ১০টি পদের। অর্ধেকেরও কম জনবলের কারণে প্রকল্পের কোনো কাজই সময় মতো সম্ভব হয়নি। এছাড়া একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগের ব্যবস্থা থাকলেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে উপযুক্ত লোক না পাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদটিও শূন্য। ফলে প্রকল্পের কাজ আরও পিছিয়ে গেছে।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম সার্ভিস প্যাকেজ-৩ এর আওতায় সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ গত ২৩ মাস ধরে এখানে কোনো পরামর্শক পাওয়া যায়নি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রধান প্রাধন কার্যক্রমগুলো অধরায় রয়ে গেছে। যেমন, একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈত্র্যের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার এবং ইকো ট্যুরিজম ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে না। এমনকি দ্বীপের কোরাল এবং ফ্লোরা ও ফনা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে উপযুক্ত সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সেন্টমার্টিন দ্বীপের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি গড়ে তোলা এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হচ্ছে না। এছাড়া মেরিন পার্কের এক্সসরিজ সংরক্ষণ, মাল্টিমিটার, কাঠ নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার, ডিমমার্বেশন জোনিং, টার্টল হেচারী গ্রাউন্ড এবং সেফটি অ্যাংকারের কাজ অধরা রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন পণ্য, কার্য ও সেবা কেনার জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। প্যাকেজগুলোর চুক্তি সাক্ষর সময়মতো না হওয়ায় এখাতে প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৭ লাখ ২২ হাজার টাকা। বাকি অর্থ অর্থাৎ ১ কোটি ২২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা পড়ে আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সেন্ট মার্টিন নারিকেল জিঞ্জিরাখ্যাত সমতল ভূমি থেকে সর্বদক্ষিণে চ্যানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশগত প্রবালদ্বীপ। এই দ্বীপে কোরাল পাওয়া যায়। দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ এ দ্বীপে ৬৮টি প্রজাতির প্রবাল আছে। ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এছাড়া উদ্ভিদ রয়েছে ১৭৫ প্রজাতির। এসব জীবচিত্র্য রক্ষার্থেই প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শুরু হয়।
এই দ্বীপে গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার পর্যটক আসে। সুতরাং পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কঠিন হবে। সমুদ্র সৈকতে এক ধরনের যানবাহন চলাচলের কারণে বালিয়াড়ি নষ্ট হচ্ছে এবং সামুদ্রিক কচ্ছপসহ অন্যাণ্য প্রাণীদের অবাসস্থলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সেন্ট মার্টিনের দৈনিক পর্যটক থারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৮৩৫ জন। কিন্তু ৫ থেকে ৭ হাজার জন অবস্থান করছে।
বিশাল পর্যটকদের সেবা দেওয়ার জন্য অপরিকল্পিত দোকানপাট গড়ে উঠেছে। পর্যটকের চাপে পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। সাগরে জমা হওয়া ৮০ শতাংশই প্লাস্টিক ব্যবহারের পর খোলা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। জমে থাকা প্লাস্টিক ধীরে ধীরে সাগরে গিয়ে মিশে যাচ্ছে। দ্বীপের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগ জরুরি। দ্বীপে অরক্ষিত পরিবেশ অধিদপ্তরের মেরিন পার্ক। কিন্তু সেটি এখন পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র রক্ষায় মেরিন পার্কের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বীপে একটি সমন্বিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা (সৌর বিদ্যুৎ) এবং সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু জরুরি। সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষার্থেই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি বলে দাবি করেছে আইএমইডি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০২০
এমআইএস/এজে