ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

এ বছরও ১০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২১
এ বছরও ১০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের

ঢাকা: কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও করোনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি, অতিরিক্ত গরম, বর্ষাকাল ও বৃষ্টির জন্য এ বছরও ১০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।  

তারা বলেন, চামড়ার বড় শত্রু গরম ও বৃষ্টির পানি পেলেই দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়া গত বছর থেকেই করোনার জন্য কোরবানি কমে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থাও খারাপ। পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে নিজেদের কাছে অতিরিক্ত সময় রেখে দেন। ফলে চামড়ার গুণগতমান নষ্ট হয়। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দেওয়াসহ ঢাকার বাইরের চামড়া লবণ দিয়ে আনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।  

ব্যবসায়ীরা জানান, পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে পশু আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের প্রায় সাড়ে ১২ লাখ খামারে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষসহ অন্যান্য পশুর প্রজনন ও লালন-পালন করা হচ্ছে। কৃষি খাতের এ সেক্টরটি এখন স্বনির্ভরতার পথে। মহামারি করোনার কারণে গত বছর কাঙ্ক্ষিত হারে দেশে কোরবানি হতে পারেনি। এবারের করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় কাঁচা চামড়া সংরক্ষণও কমে যাওয়া বা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ কমে গেলে এ শিল্প খাত কাঁচামাল সঙ্কটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ সারা বছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ করা হয় কোরবানির সময়। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে শিল্প, বাণিজ্য, মৎস্য, পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা করোনা পরিস্থিতি ও চলমান ‘লকডাউনে’ কোরবানির কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও তাদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, কোরবানির চামড়ার গুণগতমান নিশ্চিত করতে যথাযথভাবে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে যাতে কোনো চামড়া নষ্ট না হয়। সরকার এ বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য দেশের প্রচার মাধ্যমে টিভিসি প্রচার, লিফলেট বিতরণসহ পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য গরিবের হক। গরিবদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। গত বছর যা ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর যা ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা। গত বছর যা ছিল ১৩ থেকে ১৫ টাকা। এক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপশি বকরির চামড়ার দাম নির্ধরণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা। গত বছর যা ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় নিশ্চিত করতে হবে।

টিপু মুনশি বলেন, চামড়া ক্রয় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে এবং খেলাপি ঋণের ৩ শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছে। দেশে লবণের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান বাংলানিউজকে বলেন, সারা বিশ্বই করোনা মহামারির মধ্যে সংকটে আছে। আমাদের চামড়া শিল্প এর থাকে বাদ পড়েনি। আমরা চিন্তিত ছিলাম এ বছর আশানুরূপ কোরবানি হবে না। কিন্তু হাটগুলোতে যে হারে দেশি গুরু-ছাগল বেচাকেনা হচ্ছে তাতে আমরা আশা করছি কিছু কম হলেও গত বছরের মতো কোরবানি হবে। কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।  

তিনি বলেন, চামড়া সংগ্রহের জন্য আমাদের লোকজন সারাদেশেই লবণ নিয়ে প্রস্তুত আছে চামড়া সংরক্ষণের জন্য। তারপরও গরম, বৃষ্টির কারণে কিছু চামড়া এ বছরও নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য আমি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানাবো চামড়াটা যেন ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে লবণ দেওয়া হয়। তাহলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই লবণযুক্ত চামড়া কিনবো। আগের বছর ৬০ থেকে ৬৪ লাখ চামড়া ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে। পোস্তায় কাঁচা চামড়া আসে এক লাখ ৫০ হাজার। কোরবানির তিন দিন পর থেকে ১০ লাখ চামড়া আমাদের এখানে আসে।  

আবতাফ বলেন, করোনার কারণে রপ্তানি কম হওয়ায় পেমেন্ট কম হয়েছে। তাই চামড়া সংগ্রহ নিয়ে আতঙ্কে আছি। আমরা রানিং বছরের ফুল পেমেন্ট পেয়েছি। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে বকেয়া পড়েছে তা এখনও অনেকে পায়নি। এ বছরও ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানাবো আপনারা চামড়া কেনার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দেবেন। ঢাকার বাইরের চামড়া লবণ ছাড়া ঢাকাতে আনবেন না।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে সারা বছর যত চামড়া বাজারে আসে তার ৬০ শতাংশই আসে এ ঈদের সময়। কারণ ঈদুল আজহার সময় ভালো মানের পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এ সময় যেসব পশু কোরবানি দেওয়া হয় সেগুলো খুব যত্নে লালন পালন করা হয়। সেজন্য দেখা যায়, চামড়ার মানও ভালো থাকে। এ চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

তিনি বলেন, এ বছর চামড়া ব্যবসায়ী, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে আশা করছি এ বছর চামড়া সংগ্রহ ভালো হবে। তবে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো চামড়া সময় মতো সংরক্ষণ করা। একইসঙ্গে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রতিবছরই আমাদের কিছু চামড়া নষ্ট হয় অসচেতনতার জন্য। এ বছর প্রচার-প্রচারণা ভালো আছে করোনার জন্য যে ‘লকডাউন’ তাতে শিল্প কলকারখানা আওতামুক্ত আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না। তবে বৃষ্টি, গরমের জন্য কিছু চামড়া নষ্ট হবে। এজন্য ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দিয়ে সংরক্ষণের আহবান জানান।

কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগটা কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এক কোটি ফুট কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ তেমন কোনো বিষয় না। এটা না দেওয়াই ঠিক ছিল। এটা দিলে যে তেমন কিছু হবে সে রকম কিছু না। প্রতিবছর বর্ডার দিয়ে কিছু পাচার হয়ে থাকে সেদিকে একটু নজর দিতে হবে সরকারকে।  

ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চাহিদা, উৎপাদন, সরবরাহ ও চামড়া শিল্পের ক্রমাবনতির ওপর সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের রপ্তানিমুখী খাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম হলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়া শিল্পের প্রধান উপকরণ কাঁচা চামড়ার বাৎসরিক যোগানের প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি আসে পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানির পশু থেকে। গত বছরের কোরবানির সময় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশুর চামড়ার যোগান ছিল। এ বছর দেশে কোরবানির চাহিদা পূরণের জন্য ইতোমধ্যেই প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বিভিন্ন প্রকারের হৃষ্টপুষ্ট পশু প্রস্তুত রয়েছে। এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জড়িত রয়েছে। কিন্তু দেশের এ সম্ভাবনাময় খাতটি গত তিন বছর ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনছে।

প্রতিবেদনে গরু-ছাগলের চাহিদা ও যোগানের একটি তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, এবার কোরবানির পশু (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া) প্রস্তুত আছে ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। ২০২০ সালে ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার। তার আগে ২০১৯ সালে ১ কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ও ২০১৮ সালে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল। চলতি বছর আনুমানিক ৯৯ লাখ ২২ হাজার পশু কোরবানি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২০ সালে পশু কোরবানি হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার। তার আগে ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ও ২০১৮ সালে ১ কোটি ৫ লাখ ৬৯ হাজার পশু কোরবানি হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২৩২৪ ঘণ্টা, জুলাই ২০২১
জিসিজি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।