ঢাকা: বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী নিয়োগে সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করেছে সেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যহত হবে।
দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকগুলোর নতুন শাখা খোলার পরিবর্তে অনেক শাখা বন্ধ হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর খরচ বেড়ে গেলে সরকার ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ঋণ ও আমানতের সুদের যে হার (৯-৬) বেধে দিয়েছে, সেই সুদের হারও বেড়ে যেতে পারে। তাই এই সার্কুলার বাতিলের দাবি জানিয়েছে ব্যাংক মালিক ও ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা।
বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করে দেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো বলছে, ব্যাংকে শুরুর স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি ব্যাংকগুলো সবসময়ই বিশেষ মানবিক আচরণ করে থাকে। এই লেভেলের কর্মীদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, কলে ও বিশ্ববিদ্যালয়েল সুনাম বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলো নিচের স্তরের কর্মীদের বেতনকাঠামো ঠিক করেছে। যা ব্যাংকগুলোর সামর্থ্য ও পদ ভেদে গড়ে বর্তমানে ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে আছে। এই বেতন মাসে পেয়ে থাকেন ব্রাঞ্চ কাস্টমার সার্ভিস অফিসার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশ টেলার অথবা অফিসার গ্রেড-১ কর্মকর্তারা। আবার একই পর্যায়ের অফিসার যিনি যোগ দেন দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ধরা যাক প্রথম শ্রেণির অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি নিয়ে, তিনি এক্ষেত্রে পান মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
নিচের দিকের এই কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেধা ও যোগ্যতা যেমন ভিন্ন, তেমন ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের আলাদা গুরুত্বের বিচারে এদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিধির বলয়টিও ভিন্ন। এখন ঢালাওভাবে যদি ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলের সব ক্যাশ/নন-ক্যাশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কিংবা ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রত্যন্ত গ্রামের একটি শাখার এন্ট্রি লেভেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য না টেনে এনে সবার বেতন প্রথমে মাসে ২৮হাজার টাকা এবং ৬ মাস বা ১ বছর পরেই ৩৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি হবে চরম অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক।
চলমান কঠিন সময়ে এ ধরণের পদক্ষেপ ব্যাংক ভেদে একেকটি ব্যাংকের স্যালারি ব্যয় বছরে সর্বনিম্ন ১০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি টাকা বা তারও বেশি বাড়িয়ে দেবে। পুরো ব্যাংক খাতের জন্য এই ব্যয় বাড়বে বছরে ২৫০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, সার্কুলারে ব্যাংকে কাজ করা নিজস্ব মেসেঞ্জার, পিয়ন, ড্রাইভার, দারওয়ান, ক্লিনার, গার্ড পর্যায়ের কর্মীদের প্রারম্ভিক বেতন ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অন্য কোম্পানি থেকে সেবা গ্রহণ চুক্তির আওতায় নেওয়া ‘আউটসোর্সড‘ পিয়ন, ড্রাইভার, দারওয়ান, ক্লিনারদের বেতন বলা হয়েছে ওই ২৪ হাজার টাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঠিক করতে। অর্থাৎ সেটি মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা করতে হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
মেসেঞ্জার, পিয়ন, ড্রাইভার, দারওয়ান, ক্লিনার, গার্ডদের প্রারম্ভিক বেতন এ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটা ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য আরেকটি বড় আঘাত হবে। এই সব কর্মীরা ব্যাংক ভেদে ও অঞ্চল ভেদে গড়ে ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পেয়ে থাকে। সম্মিলিতভাবে এই স্তরগুলোয় প্রতিটি ব্যাংকেই হাজার-হাজার কর্মী কাজ করছে। এখানে যেমন আছে ঢাকা শহরের বড় অফিসে কাজ করা স্নাতক পাশ কোনো গার্ড সুপারভাইজার, তেমন আছে বাংলাবান্ধার মতো ছোট বর্ডারটাউনে কাজ করা স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন কোনো এটিএম বুথের গার্ডও। ঢালাওভাবে এই পর্যায়ের সব কর্মীর বেতন মাসে ২৪ হাজার টাকা স্থির করে দেওয়াটা ব্যাংকগুলোকে এক যুক্তিহীন বড় আর্থিক ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেবে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা ও কাজের অদক্ষতা প্রদর্শন সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোকে নিচের দিকের সব কর্মী, সাপোর্ট স্টাফ, অফিসার, ক্যাশ অফিসার এদের বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি ও প্রমোশন চালিয়ে যেতে হবে।
এতে ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল মেরুদণ্ড ‘কেপিআই’ ও ‘পারফরমেন্স ম্যানেজমেন্ট’ ভেঙে পড়বে। অদক্ষতা ও অযোগ্যতাকে সমর্থনকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সার্টিফিকেটের ফলে ব্যাংকগুলির সার্বিক অদক্ষতা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতাদের কর্মস্থলে পরিণত হবে। কমকর্তা কর্মচারীদের মনোবল ও কর্মস্পৃহা অটুট রাখার লক্ষ্য মাথায় নিয়ে যদি তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা ও কাজে অদক্ষতাকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে ফেলা হয়, তাহলে তা শুধু ভুল পদক্ষেপই না, ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য তা বিরাট আত্মঘাতী এক পদক্ষেপও বটে।
ব্যাংকগুলো এই মহামারির মধ্যেও ঋণের সুদহার কমিয়েছে, ফিক্সড ডিপোজিটে এখন মুদ্রাস্ফীতির সমান সুদ বা লাভ বিতরণ করছে, অন্য সার্কুলারের কারণে বড় অংকের ফি-কমিশন আয় হারিয়েছে, আবার একই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা দিতে উপশাখা বা সাব ব্রাঞ্চ খুলে তারা ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ব্যাংকাররা মনে করেন, এই সার্কুলারটি সর্বোপরি ব্যাংকগুলোকে দূরাঞ্চলে নতুন শাখা বা উপশাখা খুলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সহায়তা করা দূরের কথা, তাদেরকে বর্তমানে চালু অনেক পূর্ণাঙ্গ শাখা বন্ধ করে দিতেও বাধ্য করবে।
মফস্বলের জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি কাজের বা নানা সংস্থার এ পর্যায়ের কর্মীদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা একদমই বিবেচনায় না নিয়ে, হঠাৎ শুধুমাত্র বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পিয়ন-দারোয়ান ও ক্যাশ টেলারদের বেতন চাকরির শুরুতেই ২৪হাজার কি ৩৯ হাজার টাকায় নেওয়া অযৌক্তিক এবং এটি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য অশুভ।
ঢাকাসহ আরও সাত-আটটি বড় শহর বাদে এদেশে এখনও মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাংক ব্যবসায়ের সুযোগ ও ব্যাপ্তি অনেক কম। সেই সব অঞ্চলে অখ্যাত কোনো কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে বেরোনো ক্যাশ বা শাখা গ্রাহক অফিসারের বা অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসারের বেতন যদি দিতে হয় মাসে ৩৯ হাজার টাকা ও সেখানকার গার্ড-পিয়ন-ক্লিনারের বেতন যদি দিতে হয় মাসে ২৪হাজার টাকা এবং তদুপরি তাদেরকে যদি কাজে অদক্ষতার পরে বছর শেষে আবার বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও প্রমোশনও দিয়ে যেতে হয়, তাহলে নিশ্চিত সামান্য কটি বড় শহরের বাইরে ব্যাংক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া নিয়েই এ দেশের ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ভাবতে হবে। এর শেষ পরিণতি হিসেবে আমরা দেখব বড় শহরগুলোর বাইরে ব্যাংকিংয়ের অবসান ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রযাত্রার মুখ থুবড়ে পড়া।
স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এবং অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি ও সংস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেতন নির্ধারণ করা ব্যাংকিংখাতের জন্য আশঙ্কাজনক। দেশের আইন ও বিধিবিধানের পরিপন্থীও। ব্যাংকিংখাতের স্বার্থেই মেধা-অভিজ্ঞতা-লেভেল ও কাজের গুরুত্বভিত্তিক ব্যাংক পেশার বেতন কাঠামোর পক্ষে থাকা উচিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০২২
এসই/জেডএ