ঢাকা: আগামী অর্থবছর খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী স্ট্যাগফ্লেশন (অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যুগপৎ নিম্ন প্রবৃদ্ধি)-এর ফলে যে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়তে শুরু করেছে।
শনিবার (১১ জুন) দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উন্নয়ন সমন্বয়’ কেন্দ্রের আয়োজনে ‘কেমন হলো বাজেট ২০২২-২৩’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে আতিউর রহমান এসব কথা বলেন।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারম্যান ও সাবেক এ গভর্নর বলেন, বাজেট প্রস্তাবনাটি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাজেটপ্রণেতারা সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো যথার্থভাবে চিহ্নিত করে এগুলোর বিষয়ে সচেতন থেকেই বাজেট প্রস্তুত করেছেন। এ সংবেদনশীলতার বড় উদাহরণ হতে পারে জ্বালানি, সার ইত্যাদি বাবদ ভর্তুকি ও প্রণোদনায় দেওয়া বরাদ্দ বৃদ্ধি থেকে। আসন্ন অর্থবছরে এ বাবদ বরাদ্দ প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। মোট হিসেবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে এটি বেড়েছে। জিডিপির শতাংশ হিসেবেও আসন্ন অর্থবছরে এ বরাদ্দের অনুপাত বেড়েছে। চলতি বছরে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ভর্তুকি ও প্রণোদনা ১.৭ শতাংশ। আসছে বছরে হচ্ছে ১.৯ শতাংশ। অথচ বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে চলতি বছর থেকে আসছে বছরে বাজেটের আকার ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দুটোই কিন্তু কমাতে হয়েছে। এর মধ্যেও ভর্তুকি ও প্রণোদনার অনুপাত বৃদ্ধিকে স্বাগত জানাতেই হবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন এ অনুপাত প্রয়োজনবোধে আরও বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, আসন্ন অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলো মাথায় রেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোরও সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয়। যেমন- অনুন্নয়ন বা পরিচালন ব্যয় প্রস্তাবিত বাজেটে ৪ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বা উপখাতে মূলধন ব্যয় কমিয়ে এ অনুপাত কমানো যেত। একইভাবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট বাজেটের ১২ শতাংশ যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেখানেও এখনই জরুরি নয় এমন প্রকল্পগুলোতে অর্থ কম দিয়ে বা একেবারেই না দিয়ে চাপ কমানো যেত।
সার্বিক বাজেট পর্যালোচনা করে এ সময় তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা সামনে আনেন। বাজেট চূড়ান্ত করার আগে আইন প্রণেতাদের এগুলো বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রস্তাবনাগুলো হলো-
১. প্রথমেই বলতে চাই যে, আমাদের বাজেট ঘাটতি আরও ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.৪ শতাংশ করা যায়। তাতে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া যাবে সামাজিক খাতগুলোতে। তবে উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ঋণ না নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হবে।
২. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার কথা ভাবা যায়। বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে কভারেজ ও সহায়তা দুটোই বাড়াতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে নগরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে।
৩. স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ করার চেষ্টা করা দরকার। আর এক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের উপখাতে এ বাড়তি বরাদ্দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিতে হবে।
৪. কৃষি ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর গড় ভর্তুকির চেয়ে অন্তত দুই গুণ বরাদ্দ অর্থাৎ অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা কৃষি ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ দেওয়া গেলে তা একইসঙ্গে কৃষির বিকাশ, খাদ্য আমদানি হ্রাস ও সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হবে।
৫. চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আম নিয়ে আসার জন্য যে ‘ম্যাঙ্গো ট্রেন’ রয়েছে তার আদলে অন্যান্য কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণেও সহায়তার নতুন উদ্যোগ নেওয়া যায়। একইসঙ্গে অনলাইনে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের বিদ্যমান প্ল্যাটফর্ম ও নতুন স্টার্টআপগুলোর জন্য প্রণোদনার কথা ভাবা দরকার।
৬. মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে ইন্টার-অপরেবিলিটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। এ এমএফএস ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সল্যুশনগুলো ব্যবহার করে কী করে আরও সহজে দেশে রেমিট্যান্স নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে নতুন উদ্যোগের কথা বাজেট প্রস্তাবে যুক্ত করা যায়।
৭. আমদানি ব্যয় কমাতে পারলে বহিঃঅর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপ মোকাবিলা করা সহজ হয়। দেশীয় কোম্পানি জাহাজ তৈরি করলে বা কিনে এনে তা দিয়ে আমদানি-রপ্তানির কাজ করা গেলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমবে। এতে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। তবে বছরে বেঁচে যাবে ৪০ থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৮. ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাবদ নাগরিকদের ব্যয় বৃদ্ধির যে সম্ভাবনা কর প্রস্তাব কারণে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা দরকার। একইসঙ্গে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা বাতিল করাই শ্রেয় হবে।
৯. পদ্মাসেতু চালু হলে গোটা অর্থনীতিই নতুন গতি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের কানেক্টিভিটির যে নাটকীয় উন্নতি হবে তার সর্বোচ্চ সুফল ঘরে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য ওই অঞ্চলে বিনিয়োগে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবা যায়। বিভিন্ন স্টার্টআপ তহবিলের একটি অংশ ওই অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথাও বিবেচনা করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে উন্নয়ন সমন্বয় কেন্দ্রের সদস্য জিনিয়া শারমিন, ড. জালাল উদ্দিন আহমেদ, খন্দকার সাখাওয়াত হোসেনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২২
এইচএমএস/আরবি