ঢাকা: প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, আগামীতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
শনিবার (২৯ অক্টোবর) এফবিসিসিআই মিলনায়তনে ‘দ্য রোল অব পিপিপি ইন অ্যাচিভিং ভিশন-২০৪১’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
সালমান এফ রহমান বলেন, পিপিপি অথরিটি করার পর যেসব প্রজেক্ট হয়েছে, আপনারা (ব্যবসায়ী) সেগুলোর কথা বলেছেন, এটা অনেক আগে থেকেই হয়েছে। স্বাধীনতার সময় আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জিরো রিজার্ভ। আমরা জিটুজি প্রক্রিয়ায় আমদানি করতাম। ঠিক সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম এবং বলেছিলাম, যেহেতু আমাদের সমস্যা, আমরা বেসরকারি খাতে মুভ করছি না কেন? উনি বলেছিলেন তোমরা এটা করতে পারো, কিন্তু ৬০ পার্সেন্ট ট্রাডিশনাল এবং নন-ট্রাডিশনাল ৪০ শতাংশ রপ্তানি করতে হবে। উনি এটা বিশ্বাস করেছিলেন, দেশকে এগিয়ে যেতে হলে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, ঠিক একই ধারবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন ক্ষমতায় আসলেন, তিনি ৯৬ সালে বেসরকারি এয়ারলাইন্সকে লাইসেন্স দেন। আমি যেটা বলতে চাই, আজকে যে ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, এর মূল কারণ অনেকগুলি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের পরই আমরা অর্থনৈতিক গ্রোথটা করতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, আজকে আমাদের যে পাওয়ার জেনারেশন ক্যাপাসিটি আছে, তার ৫৪ শতাংশ বেসরকারি খাতের। বেসরকারি খাতকে আনতে চাইলে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে যেভাবে কাজ হয়েছে আমি মনে করি, পিপিপি অথরিটিতেও এভাবে কাজ করার সুযোগ আছে।
সালমান এফ রহমান বলেন, দু'টো সমস্যা আছে৷ একটা হল, পিপিপি অথরিটির কাজ হল প্রজেক্ট খোঁজা। প্রস্তাব আসার পর পিপিপির কাজ হল সে অনুযায়ী কাজ করা। বিশেষ করে যতগুলো পিপিপি আসতেছে, যারা প্রস্তাব দিচ্ছে, তার বলছে আমি যদি পাই এটা আমি করব। যখন, তারা কাজ পায়, তখন তারা ফাইন্যান্সিং খুঁজে বেড়াচ্ছে, ইনভেস্টর খুঁজে বেড়াচ্ছে। এটা একটা সমস্যা।
আমাদের একটা ফাস্ট ট্রাক করে নিতে হবে। যে প্রস্তাব দিবে, তার কাছে এভিডেন্স থাকতে হবে যে, ইক্যুইটিও আমার কাছে আছে, লোনও আমার কাছে আছে। তাহলে আর সমস্যা হবে না। বাস্তবিক অর্থেই পিপিপির অনেক সুযোগ আছে। এখন যখন আমাদের রিজার্ভ কমে আসছে, যে ইকোনমিক কন্ডিশন গ্লোবালি এ অবস্থায় আমাদের পিপিপির প্রজেক্টের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে প্রযুক্তি। আমরা দেখেছি কাগজে কলমে দেখা যায় তাদের স্বক্ষমতা আছে, কন্ট্রাক্ট দিয়ে দেওয়ার পর দেখা যায়, তা নেই। প্রুভেন টেকনোলজি দেখাতে হবে এবং যেটা বললাম ফাইনান্সিং তোমার কাছে আছে।
তিনি বলেন, আর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ঋণখেলাপী। অন্যান্য দেশে এর সমাধান আছে। কেউ যদি খেলাপী হয়, তাকে একটা এক্সিট দিতে হবে। কোম্পানিকে টেকওভার করে রি-স্ট্রাকচার করেন। যে শাস্তি পাবে, তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু, কোম্পানিটাকে রি-স্ট্রাকচার্ড করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যে খেলাপি করে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। খেলাপি দুই ধরনের। এক ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়। আরেকটা হল আসলেই সে খেলাপি। এ জন্য আমরা ব্যাংকিং আইন পরিবর্তনের চেষ্টা করছি।
প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, আমরা পিপিপি অথরিটির সঙ্গে বসব। দেখি এই আইনে সবকিছু করা যায় কি না। না হলে এই আইনও সংশোধন করব। শত চেষ্টা করেও আমরা কর দাতার সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। যারা একবার করের আওতায় ঢুকে গেছেন, তাদের ওপরই আমরা বাড়াচ্ছি। নতুন কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেছি না। যদি কোম্পানি ছোট হয়, কম কর দেবে, বড় হলে বেশি দিতে হবে। কিন্তু, কর সবাইকেই দিতে হবে।
অনু্ষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মেলবন্ধন ঘটে বঙ্গবন্ধুর আমলে। তখন, পিপিপি বলা হত না। বারডেম হাসপাতাল, মেঘনা পাওয়ারপ্ল্যান্ট, হরিপুর পাওয়ারপ্ল্যান্টসহ না প্রকল্পের উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রাইভেট খাতকে আমরা ড্রাইভিং সিটে বসাব। বৎসর অনুযায়ী কোন বছর কত বিনিয়োগ হবে৷ ২০০৯-১০ সালের দিকে প্রথম পিপিপি বাজেট আসে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময় ছিল সরকারি বিনিয়োগ ৮৫ শতাংশ আর বেসরকারি বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ ছিল। পরে আমরা ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে দেখি সরকারি বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ, আর বেসরকারি বিনিয়োগ ৮৫ শতাংশ।
তিনি আরও বলেন, পিপিপিতে পাইপলাইনে থাকা ৭৭টা কোম্পানির আকার ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এসডিজি অ্যাকশন প্লান করার সময় প্রাইভেট সেক্টর ৪২ শতাংশ, পাবলিক সেক্টর ৩৫ শতাংশ এবং পিপিতে রাখা হয়েছে ৫.৯ শতাংশ। পিপিপিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে ১৭টা মন্ত্রণালয়, ২৬টা এজেন্সি। আমরা পিপিপিতে খুব ভালোভাবেই যাব।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পিপিপি বাস্তবায়নে আমাদের মতো দেশের লাগে ২৪ মাস আর উন্নত দেশে লাগে ১৪ মাস। আমাদের প্রাইভেট সেক্টরকে আরও কীভাবে গুরুত্ব দেওয়া যায় সেটা দেব।
তিনি বলেন, এফবিসিসিআই সভাপতি বলেছেন তাদের প্রতি নাকি আমাদের বিশ্বাস কমেছে, তাই একত্রে কাজ করা যাচ্ছে না। আমি বলব হাই পারফরমিং বেসরকারি ব্যাংকগুলো কীভাবে লোন নেয় এবং পরবর্তীতে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে সেটার দিকে আপনারা নজর দেন।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঝিলমিল প্রকল্প, পূর্বাচলে পানির সংযোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার ওরিয়ন গ্রুপ করছে। এটাকে আমরা আরও বাড়াব। ১.৫ শতাংশ মোট জিডিপির পিপিতে আসুক, এটা আমরা প্রস্তাব রেখেছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবের বিষয় হল, আমরা সড়ক অবকাঠামোর আওতায় এনেছি সব এলাকা। আমরা পিপিপিতে যাব, কারণ সরকারের পক্ষে একা বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। কাজেই সব চেয়ে বেশি দেখতে হবে কীভাবে প্রাইভেট সেক্টরকে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়।
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আবেগী সিদ্ধান্ত থেকে আমাদের বের হতে হবে। পিপিপির জন্ম থেকে এই পর্যন্ত এখনো সফল হয়নি। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলে কিছুটা উন্নয়ন মিলবে।
তিনি বলেন, পিপিপিতে বিশ্বাস করতে হবে। আমাদের মতের সঙ্গে আপনাদের (সরকার) কাট পেস্ট করতে হবে। কোন দ্বিমত থাকা যাবে না। পিপিপি করেছি যেন আমরা একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। আমি আশা করি আজ একটা স্মারক (মেমোরেন্ডা) হবে।
পিপিপি অথরিটির সিইও মোহাম্মদ ইবরাহীম বলেন, পিপিপি প্রকল্প করতে গেলে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে আস্থাহীনতা। সরকার বিশ্বাস করছে না প্রাইভেট সেক্টরকে। প্রাইভেট সেক্টর বিশ্বাস করছে না সরকারকে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, পিপিপির যে পার্টনার তাকে আমরা পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করি না, তাকে আমরা কন্ট্রাক্টর হিসেবে দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের চলমান যে প্রকল্প আছে, এগুলোর সুফল যখন পেতে শুরু করব, তখন সবার আস্থা ফিরবে।
এছাড়া ওয়াটার সাপ্লাই, স্যানিটেশন এবং মিউনিসিপ্যাল ওয়েস্টেজে আগামী দিনে পিপিপি ভূমিকা রাখতে পারবে।
সভায় মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ। প্যানেল আলোচনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ, পিপিপির উপদেষ্টা মোহাম্মদ হাসান হায়দার, এফবিসিসিআই প্যানেল উপদেষ্টা ড. শামসুল হক এবং এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ২৯ অক্টোবর, ২০২২
এমকে/এমএমজেড