ঢাকা: ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। আর এ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদ ভাষাসৈনিকদের স্মরণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার।
ভাষাশহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনারের অবস্থান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানের উদ্দেশে নির্মিত হলেও বর্তমানে এর যথাযথ মান রাখা হচ্ছে না। বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িড এ স্থাপত্যের মর্যাদা শুধু চোখে পড়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতেই। ভাষা দিবসের আগে শহীদ মিনার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার ও আলোকসজ্জা এবং নিরাপত্তা বাড়ানো হলেও বছরজুড়েই থাকে অরক্ষিত অবস্থায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একদল তরুণ-তরুণী জুতাসহ শহীদ মিনারের মূল বেদিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে এবং খাবারের বিভিন্ন অংশ ফেলে নোংরা করছে মিনারের চারপাশ। একপর্যায়ে ছবি তুলে বিদায় হন তারা। এরপরই আসেন বহিরাগত এক পরিবার, তাদেরও আগের দলের মতো মূল বেদিতে জুতাসহ উঠে ছবি তুলতে দেখা যায়। এছাড়া উপস্থিত কয়জনকে পাশে বসে ধূমপান করতেও দেখা যায়। আবার বিভিন্ন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর শহীদ মিনারে কিছুটা কমতে শুরু করে জনসমাগম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের ভিড় বাড়ে। এ সময় জনসমাগমে পরিণত হয় শহীদ মিনার এলাকা। শহীদ মিনার এবং আশপাশে বসে বিভিন্ন অস্থায়ী খাবার ও খেলনার দোকান। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় শহীদ মিনারের মূল বেদিতে গিয়ে মানুষজন ছবি তুলে, আড্ডা দেয়, গানের আসর বসান। তবে মূল বেদিতে জুতা নিয়ে ওঠা কিংবা বসা নিয়ে মাঝে মাঝে সচেতন শিক্ষার্থীদের সাথে বাগ-বিতণ্ডাও হয় তাদের। কেউ কেউ আবার শহীদ মিনারে পালন করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান। অধিকাংশ সময় রাতে বসে গাঁজার আসর। নিরাপত্তার জন্য লাইটের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক সময় তা নষ্ট করে দেয় মাদকসেবীরা। তবে এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উল্লেখযোগ্য কোনও পদক্ষেপ দেখা যায় না।
পরিবার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা শিহাব উদ্দিন বলেন, কাজের ফাঁকে প্রায়ই সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে আসি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি শহীদ মিনারের প্রতি অযত্ন-অবহেলা। ভাবতেই অবাক লাগছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের এই করুণ অবস্থা। ভয় হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এসব থেকে ভালো কিছু শিখবে কীভাবে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচির প্রাণকেন্দ্র এই শহীদ মিনার। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়।
শহীদ মিনারের ভাবমূর্তি এবং মর্যাদা ক্ষুণ্নের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সামি আল জাহিদ প্রীতম বলেন, অনেক অব্যবস্থাপনার মাঝে চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল মুখে মুখেই আমরা বলে থাকি দেশের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার রয়েছে এখানে। কিন্তু এর ভাব-গাম্ভীর্য ও তাৎপর্য আমরা ধারণ করতে পারি নাই আদৌ। সারাবছরই অবহেলার স্বীকার এই শহীদ মিনার। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বহিরাগত আগমন, তাদের শহীদ মিনারের মূল বেদিতে জুতা পায়ে বসে থাকা, বাদামের খোসা, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ফেলে শহীদ মিনার ও এই প্রাঙ্গণ নোংরা করে রাখা জানান দেয় কতটা উদাসীন আমরা। যারা পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকে তারাও বড্ড বেশি অসচেতন এবং উদাসীন। তদুপরি প্রশাসনও উদাসীন, দীর্ঘদিন ধরে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ চললেও তারা আশু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি শহীদ মিনারের ভাব-গাম্ভীর্যতা ও পবিত্রতা রক্ষায়। শিক্ষার্থীদের মাঝেও প্রায়শই অচেতনতা দেখা যায়। শহীদ মিনার আমাদের মাথানত না করার শিক্ষা দেয়, তাই আমাদের সবার জায়গা থেকে আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন এবং সেসঙ্গে সবার আরও সচেষ্ট হওয়া দরকার এর ভাব-গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা রক্ষায় সেসঙ্গে মনেপ্রাণে একুশের চেতনা ধারণ করা আবশ্যক।
ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি বলেন, শহীদ মিনার আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতীক। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে যারা ভূমিকা রেখেছে, যারা মাতৃভাষার দাবিতে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে তাদের স্মরণে যে মিনার গড়ে তোলা হয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণ গুরত্বের সাথে করা জরুরি। শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই ফুল দেওয়ার প্রয়োজনে আমরা তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবো তা কিন্তু হওয়া উচিত না, বরং শহীদ মিনারের ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষা করে সারাবছর রক্ষণাবেক্ষণ করাটাও আমাদের দায়িত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ শাখার পরিচালক মো. আব্দুর রহমান সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ দেখভালের জন্য পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে আমাদের তিন জন লোক কাজ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তনতো ছোট নয়। এজন্য অনেক সময় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে এসব জন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং দর্শনার্থীদের নিজ উদ্যোগ ও সচেতনতার বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনারটি ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান উদ্বোধন করেন। ৭১ ফুট উচ্চতা ও ৫২ ফুট ব্যাসের এই শহীদ মিনারের স্থপতি রবিউল হুসাইন। আটটি সিঁড়ির ওপর ত্রিভুজাকৃতির তিনটি স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ মিনারটি। স্তম্ভ তিনটি স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের ত্যাগের মহিমা প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
এএটি