ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

নেই আর নেই হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে!

জিয়া উদ্দিন দুলাল, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
নেই আর নেই হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে!

হবিগঞ্জ: ১ বছরে ক্লাস হয় মাত্র ৩ মাস; ১ হাজার ৩শ ২ জন ছাত্রীর জন্য শিক্ষক ১৬ জন; ফলাফল সন্তোষজনক নয়; পদ আছে, শিক্ষক নেই; হোস্টেলে আসন সংকট; বিজ্ঞানাগার নেই; গ্রন্থাগার নেই; কর্মচারী সংকট; নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। এসব নিয়েই চলছে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।



প্রতিষ্ঠালগ্নের কথা: ১৯৮৫ সালে শহরের রাজনগর এলাকায় মাত্র ১.০৫ একর ভূমিতে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বছরের ১ নভেম্বর মাত্র ১৮ জন ছাত্রী নিয়ে জেলা গণগ্রন্থাগার ভবনে প্রথম পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।

এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন- তৎকালীন উপবিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার, হবিগঞ্জের প্রথম জেলা প্রশাসক শাহ নাজমুল আলম, সাবেক জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাশ উদ্দিন।

সরকারিকরণ: ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ১৮টি কলেজ জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান মরহুম শাহ এ. এম. এস. কিবরিয়ায় সহযোগিতায় কলেজটি সরকারি হয়।

ছাত্রী ও শিক্ষকের সংখ্যা: কলেজে বর্তমান ছাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার ৩শ ২ জন। এর মধ্যে একাদশ শ্রেণীতে মানবিকে ৪শ ৫০ জন ও বিজ্ঞান বিভাগে ৮৬ জন, দ্বাদশ শ্রেণীতে মানবিক বিভাগে ৩শ ১ জন ও বিজ্ঞান বিভাগে ৩৭ জন ছাত্রী রয়েছে। এ ছাড়া বিএ(পাস কোর্স) ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষ মিলিয়ে ১শ ৩৪ জন এবং বিএসএস-এ ৪শ ২৮ জন ছাত্রী রয়েছে।

কলেজে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ বাদে শিক্ষকের সৃষ্ট পদ সংখ্যা মাত্র ২০। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১৬ জন। এ ১৬ জনের মধ্যে সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের পদ না থাকায় যে কোনো সময় বদলি হতে পারেন ৪ জন শিক্ষক।

কর্মচারী সংকট: কলেজের প্রধান সহকারীর একটি ও এমএলএসএসের ৩টি পদ অনেকদিন ধরে খালি রয়েছে। বর্তমানে কম্পিউটার অপারেটর-কাম-অফিস সহকারী অধির চন্দ্র গোপ প্রধান সহকারীর দায়িত্ব পালন করছেন।

আবাসন ও একাডেমিক ভবনের সংকট, বিজ্ঞানাগার ও খেলার মাঠহীন ক্যাম্পাস: হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে মাত্র ২টি ৩ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন রয়েছে। এ ২টি ভবনের মধ্যেই অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষের কার্যালয়, শিক্ষক মিলনায়তন, ছাত্রী মিলনায়তনসহ সবকিছু। ফলে, বিভিন্ন পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের আসন সংকট দেখা দেওয়ায় পাশের হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ব্যবহার করতে হয়।

কলেজ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ স্টাফদের আবাসন ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় জমির অভাবে একটি বিজ্ঞানাগারও খোলা যাচ্ছে না। নেই শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মাঠ। বিভিন্ন উৎসব ও প্রতিযোগিতায় কলেজ সংলগ্ন হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি পূর্বানুমতি নিয়ে ব্যবহার করতে হয়।

৮ মাসই পরীক্ষা: হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজটি একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বছরের ১২ মাসের মধ্যে এ কলেজে গড়ে ৮ মাসেই পরীক্ষা থাকে। বাকি ৪ মাসের মধ্যে সাপ্তাহিক ও বিভিন্ন সরকারি ছুটির কারণে গড়ে ৩ মাসও পরিপূর্ণ ক্লাস হয় না।

সরকারি নীতিমালার কারণে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের অনার্স ও ডিগ্রির সব পরীক্ষা হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে, এ কলেজের ছাত্রীরা নিয়মিত পাঠ থেকে বঞ্চিত হন।

ছাত্রী ও শিক্ষকের কথা: কলেজের ছাত্রীনিবাসের বিএসএস ১ম বর্ষের (ওল্ড ফার্স্ট ইয়ার) শিক্ষার্থী খালেদা আক্তার শিমু বাংলানিউজকে জানান, এ কলেজটি ১টি পরীক্ষা কেন্দ্র হয়ে গেছে। সে কারণে শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে থাকতে চায় না।

কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা সৈয়দা শাকিলা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, পাঠদানে শিক্ষকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলেও প্রায় ৮ মাস পরীক্ষা থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে পাঠ নিতে পারে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের একজন প্রভাষক জানান, ‍‌‌‍‍‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‍কলেজে ক্লাস থাকলে তাদেরও লাভ হয়। ছাত্রীদের ভালোভাবে পাঠ দেওয়ার স্বার্থে তারাও কিছুটা সময় পড়াশুনা করতে পারে। কিন্তু কলেজে বছরের অধিকাংশ সময় পরীক্ষা থাকায় নিজেদের লেখাপড়ায় অলসতা এসে যায়। আর ছাত্রীদের কী পড়াবে!  

ফলাফল: কলেজে বছরের বেশিরভাগ সময় পরীক্ষা থাকায় পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষার মানের আশারূনুপ উন্নতি হচ্ছে না বলে ছাত্রীদের অভিযোগ।

২০১১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক ও বিজ্ঞান শাখায় ৪শ ৪৬ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে ২শ ৬২ জন পাস করেন। পাসের হার ৫৯ শতাংশ। ২০১২ সালে ৪শ ৬৪ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেন ৩শ ৫৮ জন। গত বছরের পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৭৯ শতাংশ।

২০০৯ শিক্ষাবর্ষে বিএ ও বিএসএস মিলিয়ে ২শ ৩৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০৯ জন পাস করেন। পাসের হার ৮৮.৯৩ শতাংশ। ২০১০ শিক্ষাবর্ষে ২শ ৭০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেন ২শ ৪০ জন। পাসের হার ৮৮.৮৮ শতাংশ। এ ২ বছরে পাসের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ছাত্রীনিবাসের  আসন সংকট: দূরের ছাত্রীদের থাকার সুবিধার্থে কলেজে ৪ তলা বিশিষ্ট একটি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এতে ৯৬টি আসন রয়েছে। ছাত্রীনিবাসে ওঠার জন্য ছাত্রীদের অনেক আবেদন থাকলেও আসন সংকট থাকায় তাদের স্থান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এ ছাড়া ছাত্রীনিবাসে সুপারের ভবন না থাকায় দাপ্তরিক কাজ শেষে সুপারকে বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরতে হয়।

নিরাপদ পানির অভাব: ছাত্রীনিবাসে নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। পানিতে অতিরিক্ত আয়রন থাকায় চুলপড়াসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় বলে ছাত্রীরা অভিযোগ করেন। খাবারের পানির জন্য ছাত্রীনিবাস থেকে প্রায় ৩শ গজ দূরে একাডেমিক ভবন সংলগ্ন একটি মাত্র টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে হয়।

বিনোদনের অভাব: কলেজে ছাত্রীদের বিনোদনের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। ছোট একটি কক্ষে একটি টেলিভিশন (শুধুমাত্র বিটিভি) ও খেলার জন্য একটি ক্যারম বোর্ড ও দাবা ছাড়া আর কিছুই নেই। জমির স্বল্পতার কারণে বৃহৎ পরিসরে বিনোদনের ব্যবস্থা তো দূরে থাক, চলাফেরা করার জন্যও জায়গা নেই।

অধ্যক্ষের কথা: অধ্যক্ষ জাহান আরা খাতুন বাংলানউজকে জানান, হবিগঞ্জের নারী শিক্ষার একমাত্র সর্বোচ্চ সরকারি বিদ্যাপীঠ নানা সমস্যায় জর্জরিত। কলেজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের সৃষ্ট পদ নেই। পদ থাকলেও শিক্ষক নেই। বিশুদ্ধ পানির সংকট, অবকাঠামোগত সমস্যা, নেই একাডেমিক ভবন, খেলার মাঠসহ আরও অনেক কিছু। এর ওপর পরীক্ষার চাপ। সব মিলিয়ে এ কলেজের সমস্যার অন্ত নেই।

তিনি জানান, ছাত্রীনিবাসে নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে হবিগঞ্জ পৌরসভা মেয়রের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ইতোমধ্যে কাজের অনেক অগ্রগতিও হয়েছে।

১ মাসের মধ্যে নিরাপদ পানির সংকট দূর হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অধ্যক্ষ জাহান আরা খাতুন জানান, ইতোমধ্যে কলেজের জন্য ছাত্রীনিবাস সংলগ্ন পশ্চিম দিকের ৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ করতে মহাপরিচালকের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে; যা প্রক্রিয়াধীন।

এ জমিটি পেলে আরও ২টি একাডেমিক ভবন, ১টি বিজ্ঞান ভবন, একটি অডিটরিয়াম, ছাত্রীনিবাসের আরেকটি ভবন ও শিক্ষকদের আবাসিক ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হবে। তখন অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।

তিনি আরও জানান, কলেজের প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের জন্য ১ জন করে প্রদর্শকের পদ সৃষ্টি করা দরকার। এ ছাড়া সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপকসহ শিক্ষকের আরও কয়েকটি পদ সৃষ্টির আবেদন করা হয়েছে।

এজন্য, ইতোমধ্যে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আবু তাহেরকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি পদ সৃষ্টিসহ কলেজের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।