বাংলাদেশের নানা প্রান্তে অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী ঘটনায় সরকারকে আরও তৎপর হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এসব ঘটনায় আলাপ-আলোচনা, সংলাপের বা শক্ত হাতে দমনের প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে তারা।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক খোলা চিঠিতে এই আহ্বান জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস বরারবর লিখিত চিঠিটি শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন। চিঠির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো হবে।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজলী শেহরীন ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাছির আহমেদসহ প্রমুখ।
লিখিত চিঠিতে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ্য করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে কেবল হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সেসব মানুষের ওপর হামলাও চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাস্তায় ও পর্যটন অঞ্চলে নারীদের ওপর হামলা, নিগ্রহ এবং চরম হেনস্তা করা হয়েছে। শ্রমিকদের নিগৃহীত করেছেন মালিকপক্ষের গুণ্ডারা। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও দপ্তরে ছোট ছোট অজস্র হিংস্রতার ঘটনা ঘটেই চলছে। মাজার, মন্দির, শিল্প- স্থাপনা ভাংচুর থেকে শুরু করে বাউল ও আহমেদিয়াদের ওপরও আক্রমণ হয়েছে।
‘এসব দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন সমাজের মধ্যকার নানাবিধ অমীমাংসা ও গণতন্ত্রহীনতার সাথে সম্পর্কিত বলে আমরা মনে করি। এভাবে চলতে থাকলে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধের অভাব তীব্রতর হবে এবং সংকট উত্তরণে সরকারকে আরও বেগ পেতে হবে। ’
অতি উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণুতা প্রশমণের জন্য যারা এসব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন, তাদের থামাতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সামিনা লুৎফার আলোচনা বাতিলে উদ্বেগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই গণঅভুত্থানের চেতনায় কেমন বাংলাদেশ চাই?’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় আজ আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক নেটওয়ার্কের সক্রিয় সদস্য সামিনা লুৎফা। তবে এই শিক্ষকের উপর আপত্তি জানিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে আলোচনাটি বাতিল হয়েছে।
এ বিষয়ে চিঠিতে গীতি আরা নাসরীন বলেন, অতিউৎসাহী গোষ্ঠীকে না থামিয়ে সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে কোনো গোষ্ঠির কথা পালনে বাধ্য করেন, যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানের কোন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা হলো? সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে যে তারা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবেন। অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে নীতিসমূহের মাধ্যমে কী করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবেন।
সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী বলেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কোনো নমুনা আমরা দেখছি না। ওনার (সামিনা লৎফার) বাবা-মা সেখানে চাকরি করতেন। সে সূত্রে ওনার একটা সংযোগও আছে। কিন্তু নানারকম হুমকির কারণে তিনি সেখানে যেতে পারেননি।
অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অধীনে প্রণীত সকল পুস্তক সংস্কারে ১০ সদস্যের একটি কমিটিতে রয়েছেন শিক্ষক নেটওয়ার্কের ড. সামিনা লৎফা, অধ্যাপক কামরুল ইসলাম মামুন, ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। এরমধ্যে সামিনা লুৎফা ও কামরুল হাসান মামুনের বিরুদ্ধে ধর্ম বিদ্বেষের অভিযোগ এনে অপসারণ চেয়েছে একটি অংশ।
এ বিষয়ে রুশাদ ফরিদী বলেন, ওনাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু ওনাদেরকে ধর্মবিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে বাদ দিতে চাওয়া সমাজে অস্থিরতা ও সংঘাত তৈরি করবে। স্বৈরাচারের পতনের পর নতুন সমাজ গঠনে আমরা এগুলো দেখতে চাই না।
অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস বলেন, জাতির উপর থেকে এতবড় জগদ্দল পাথর সরানোর পরও আমরা যদি অসহষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জায়গায় চলে যাই। এই কমিটিতে তাকে সরাতে হবে, ঐ কমিটিতে তাকে কেন রাখা হলো-এসব না করে সরকারকে কাজ করতে দিন।
ছাত্র-শিক্ষক রজনীতি কোনো সমস্যা নয়
সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের একটি অংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়াও বাংলদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি কোনো সমস্যা নয় বলে মনে করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। রুশাদ ফরিদী বলেন, যদি দেশে আইনের শাসন থাকে, তাহলে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি কোনো সমস্যা নয়। আইনের শাসন থাকলে কেউ অন্যায় সুবিধা নিতে পারে না। তবে ছাত্রলীগের রাজনীতি, রাজনীতি নয়; গুণ্ডামি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪
এমএম