ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

অন্তহীন সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুর সরকারি কলেজ

কাদের পলাশ, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১২
অন্তহীন সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুর সরকারি কলেজ

চাঁদপুর: চাঁদপুরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চাঁদপুর সরকারি কলেজ। সরকারি হলেও অন্তহীন সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

একাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাস, বাস আর শিক্ষক সংকট নিয়ে চলছে এ কলেজের কার্যক্রম। ফলে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চাঁদপুর সরকারি কলেজ অন্যতম। এটি চাঁদপুর জেলাবাসীর গর্ব।

সুদীর্ঘ ৬৬ বছর আগে বৃহত্তর কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ও শ্রীকাইল কলেজ ছাড়া এ অঞ্চলে আর কোনো কলেজ ছিল না।

১৯৪৬ সালের ১ জুন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী এ কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন মহানুভব দানশীল ব্যক্তি, বিশেষে করে চাঁদপুরের ব্যবসায়ীদের আর্থিক অনুদানে দেশের অন্যতম এ শিক্ষাপীঠের ৩তলা ভবন নির্মিত হয়।

সে সময় ৫১ জন মহানুভব ব্যক্তি অনুদান দিয়েছিলেন ২ লাখ ১২ হাজার ৯৭২ টাকা। তাদের নামের তালিকা আজও কলেজে সংরক্ষিত আছে।

কলেজটি ১৯৮০ সালের ১ মার্চ সরকারিকরণ হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পরেশ চন্দ্র গাঙ্গুলী কলেজে প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালের উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে শুরু হলেও চাঁদপুর সরকারি কলেজটি বর্তমানে স্নাতকোত্তর কলেজে পরিণত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের অসংখ্য দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার পথ সুগম হয়েছে।

বর্তমানে এ কলেজে ১৭টি বিষয়ে অনার্স ও ১৪টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে।

বিভাগগুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, দর্শন, ইতিহাস, ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি, অর্থনীতি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ভূগোল পরিবেশ বিদ্যা, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, গণিত, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, গ্রন্থাগার, শরীরচর্চা, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট।

শুরুর কথা:
চাঁদপুর সরকারি কলেজের সৃষ্টি আকস্মিক ও কৌতুহলপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপানিদের আক্রমণে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনী নাজেহাল হচ্ছিল, তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।

ব্রিটিশ সরকারের বিমান হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তার খাতিরে ১৯৪৩ সালে ভিক্টোরিয়ার ডিগ্রি শাখা কুমিল্লার কুলিয়ারঝুরিতে ও ইন্টারমিডিয়েট শাখা চাঁদপুর সরকারি হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে চাঁদপুর থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজের এ শাখাটি আবার কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চাঁদপুরের সুধীজনরা চাঁদপুরে স্থায়ীভাবে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন।

তাই প্রথম অবস্থায় যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈনিকদের ব্যবহারের জন্য নির্মিত আজিজ আহমেদ ময়দানের (বর্তমান কলেজ মাঠে) পশ্চিম প্রান্তে জরুরি ভিত্তিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি ঘর তৈরি করা হয়। আর সেখান থেকেই চাঁদপুর কলেজের যাত্রা শুরু।

বর্তমানে এ কলেজে একাদশ শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। কলেজটিতে চাঁদপুর জেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, বরুড়া, লাকসাম ইত্যাদি স্থান থেকে অনেক ছেলে-মেয়ে এসে লেখাপড়া করছেন।

এ কলেজে বর্তমানের শিক্ষকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ৩১টি বিভাগের মধ্যে কিছু বিভাগ বর্তমানে চলছে ৪ জন ও কিছু বিভাগ চলছে ৭ জন শিক্ষক দিয়ে।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ছক অনুযায়ী, ৪ জন শিক্ষকের জায়গায় ৭ জন এবং ৭ জনের জায়গায় ১২ জন শিক্ষকের পদ সৃষ্টির জন্য বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও এখনও সেসব সমস্যা দূর হয়নি। ফলে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়ে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

কলেজটির মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে আরও ১০২ জন শিক্ষক, ১৭ জন অফিস সহকারী ও ১৭ জন এমএসএস বরাদ্দ চেয়ে গত ২০০৮ সালে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তা আজও পূরণ হয়নি।

সমস্যা, সংকট, আবেদন:
১৯৯৩ সাল থেকে এ কলেজে কোনো শিক্ষাভবন বা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়নি। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়।

এছাড়া ছাত্রদের দুটি ছাত্রাবাস শেরে-বাংলা ও শহীদ জিয়া ছাত্রবাস, ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা ছাত্রীনিবাস রয়েছে।

এর মধ্যে শেরে বাংলায় ১০৮ জন, শহীদ জিয়া ছাত্রাবাসে ৮৫ ও শেখ হাসিনা ছাত্রীনিবাসে ১০৮ জন শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে। আর অন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া থেকে পড়াশোনা করছে।

আর এসব ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসে রয়েছে নানা সমস্যা। তবে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে, পানির সমস্যা। এছাড়া অন্যান্য সমস্যা তো রয়েছেই।

শেরে বাংলা ছাত্রাবাসের ভূগোল ও পরিবশে বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র আলী আহমদে অপু  বাংলানিউজকে জানান, হোস্টেলে পানি ও টয়লেট সমস্যার কারণে ছাত্রছাত্রীদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আড্ডাও লক্ষণীয়।

রসায়ন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, ছাত্রাবাসের পাহারাদার না থাকায় বহিরাগতরা হোস্টেল এলাকায় ঢুকে মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। এ কলেজের পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

সমাজকল্যাণ বিভাগের মাস্টার্স ও হোস্টেলের ছাত্রদের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র আনিছুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বহিরাগতদের আড্ডা অনেকাংশে কমলেও হোস্টেলের দারোয়ান না থাকায় এখনও বহিরাগতদের আনাগোনা দেখা যায়।

শহীদ জিয়া ছাত্রাবাসের অর্থনীতি বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন জনি জানান, হোস্টেলের পানি সমস্যা প্রকট। আর হোস্টেল এলাকায় বহিরাগতরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে থাকে।

ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী রহিমা আক্তার কলি বাংলানিউজকে জানান, শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে লাইব্রেরি ও সেমিনার হল ও ল্যাবরেটরিতে ক্লাস করতে হচ্ছে।

রসায়নের প্রথম বর্ষের ছাত্র সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কলেজ বাস মাত্র ১টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

সমাজকর্ম বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, কলেজের ছাত্র সংসদের কোনো কার্যক্রম নেই। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ফি নিচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যত দেশ পরিচালনার জন্যে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না।

এছাড়া মেসে(ভাড়া বাড়িতে) থেকে পড়াশুনা করা কাউছার হামিদ, শাখাওয়াত হোসেন, বিএম আসফাকুজ্জামানসহ আরও অনেক ছাত্র বাংলানিউজকে জানান, হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য যে ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাস রয়েছে এটি নামমাত্র।

কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য একাধিক আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা কলেজের নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের শিক্ষক সমস্যা, একাডেমিক ভবন, হোস্টেল, যাতায়াতের সমস্যা থাকা সত্বেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সব সমস্যাগুলো পররাষ্টমন্ত্রীর মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। আশা করছি, ধীরে ধীরে সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবো। ”

চাঁদপুরবাসীর দাবি ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটির সব সমস্যা সমাধানে সরকার এগিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১২
সম্পাদনা: শামীম হোসেন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।