ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা এবং নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে চলতি বছর।
সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রতিটি ইউনিটে চলমান ভর্তি পরীক্ষার আগেই ‘প্রশ্নফাঁস হয়েছে’ বলে ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক চক্র।
এতে প্রতারকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি গচ্চা যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ফলে নিজেদের ‘গলায় ফাঁস’ পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে তাদের।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সতর্ক নজরদারির কারণে এবার ঢাবিতে প্রশ্ন জালিয়াতির সুযোগ একেবারেই কমে এসেছে। ফাঁক-ফোকর গলে যেটুকু জালিয়াতি হচ্ছে তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির দায়ে আটকদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিচারে দেওয়া হচ্ছে কঠোর শাস্তি।
ঢাবিতে চলতি ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা চলছে। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে ক (বিজ্ঞান), খ (মানবিক), গ (বাণিজ্য) ও চ (চারুকলা) ইউনিটের পরীক্ষা। আগামী শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে ঘ (সম্মিলিত) ইউনিটের পরীক্ষা।
এ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত জালিয়াতির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড হয়েছে দুই পরীক্ষার্থীর।
এদের মধ্যে গত শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে টেলিযোগাযোগে সক্ষম ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসসহ আটক হওয়া হাসিবুল হাসান শামু নামে এক শিক্ষার্থীকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এরআগে গত ১৬ অক্টোবর গ ইউনিটের পরীক্ষায় একই রোল নম্বরের দুটি আলাদা প্রবেশপত্র বানিয়ে বন্ধুকে নিয়ে পরীক্ষা দিতে আসায় সঞ্জয় কুমার সাহানী নামে এক শিক্ষার্থীকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া জালিয়াতি ও প্রশ্নফাঁসের গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন অনেকে। গত বৃহস্পতিবার রাতেই আটক করা হয় ২৩ জনকে। পরের দিন ৬ জনকে ছেড়ে দিয়ে ১৭ জনকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে ও ৪ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ঘটনা প্রবাহ থেকে জানা যায়, প্রশ্নপত্র জালিয়াতি রোধে এ বছর বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হচ্ছে প্রশ্নপত্রের সেটকোড লুকায়িত রাখা। ফলে পরীক্ষার্থীরা নিজেরাও জানতে পারছেন না তারা কোন সেটের প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছেন। এতে টেলিযোগাযোগে সক্ষম ডিভাইস নিয়ে প্রবেশ করলেও জালিয়াতচক্রের সহায়তায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর দিয়ে পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, গত শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) যে ছেলেকে আটক করা হয়েছে, তার কাছে এটিএম কার্ডের মতো দেখতে টেলিযোযোগাযোগে সক্ষম ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ছিল। পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তাকে আটক করা হয়। কিন্তু তার উত্তরপত্রে দেখা যায় এ সময়ের মধ্যে মাত্র ১০/১২টির মতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে সে।
তিনি বলেন, সেটকোড লুকানো থাকায় শিক্ষার্থী নিজেই জানতে পারছে না সে কোন সেটের উত্তর করছে। ফলে বাইরে থেকে উত্তর পাঠালেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যতগুলো প্রশ্নের উত্তর করতে পারবে তাতে পাস করা অসম্ভব।
এদিকে, প্রতিটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগেই দেখা গেছে একাধিক জায়গা থেকে প্রশ্নফাঁসের গুজব ছড়ানো হয়। একাধিক চক্র ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে লিখেছে ‘ঢাবির অমুক ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমাদের কাছে প্রশ্ন আছে। আগ্রহীরা টাকা এবং এসএসসি ও এইচএসসির মূল সনদ ও নম্বরপত্র নিয়ে দ্রুত যোগাযোগ করুন। ’
এ প্রসঙ্গে ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এএম আমজাদ বাংলানিউজকে বলেন, গুজব ছড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জালিয়াতচক্র। ফলে অগ্রিম যে টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে সেগুলো আর ফেরত নিতে পারছে না ভর্তিচ্ছুরা। কারণ তাদের এসএসসি-এইচএসসির মূল সনদ জমা রেখে তাদের জিম্মি করা হচ্ছে।
সহকারী প্রক্টর রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ক ইউনিটের পরীক্ষার আগে এ ধরনের দুটি ফেসবুক পোস্ট আমাদের নজরে আসে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় আমরা জানতে পারি তার একটি পোস্ট করা হয় ময়মনসিংহ থেকে, অপরটি ফরিদপুরের মধুখালী থেকে। তাদের আটকের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, এ ধরনের একটি চক্রের খোঁজ পেয়েই ডিবির সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ফার্মগেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৩ জনকে আটক করা হয়। এ চক্রটি প্রায় ২০ জন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকেই আগেই প্রায় ৮ লাখ টাকার মতো হাতিয়ে নেয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, প্রশ্নপত্র জালিয়াতি রোধে প্রতিনিয়তই আমরা কৌশল পরিবর্তন করছি। ফলে চক্রগুলো সফল হতে পারছে না। তাছাড়া যাদের আটক করা হয়েছে তাদের শাস্তির ব্যাপারে নিয়মিতই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। যাদের দণ্ড হয়েছে তারা নির্ধারিত সময়ের আগে মুক্তি পাবে না।
তবে পরীক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় প্রতিটি পরীক্ষার্থীর শরীর চেক করে কেন্দ্রে প্রবেশ করানো সম্ভব না হওয়ায় ক্ষুদ্র ডিভাইস নিয়ে প্রবেশের সুযোগ থেকে যায় বলেও স্বীকার করেন তিনি। কিন্তু শিক্ষকদের সতর্ক প্রহরায় তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় বলেও দাবি তার।
উপাচার্য বলেন, ঢাবিতে প্রশ্ন কখনো ফাঁস হয় না। তাই অভিভাবকদের উচিত গুজবে কান না দিয়ে ছেলে- মেয়েদের সঠিক প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করা।
বাংলাদেশ সময়: ২২৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এসএ/এসআর