ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বর্ণমালা শেখার পাঠশালা

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
বর্ণমালা শেখার পাঠশালা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: বাংলা বর্ণমালা চিনতে ও বলতে পারা দূরের কথা, বিদ্যালয়ের আঙিনাতেই কখনও পা রাখারও সুযোগ হয়নি বশিরের (৮)। ছিন্নমূল বাসিন্দাদের সঙ্গে তার আবাস ব্রহ্মপুত্র তীরে শহরের বিপিন পার্কের পেছনের বস্তিতে থাকে সে।



সমবয়সী আর দশজন শিশুর মতো বশিরের লেখাপড়ার স্বপ্ন থাকলেও পরিবারের আর্থিক অনটনে সেটা ছিল অনেকটা বিলাসিতার। কিন্তু এই বশিরই এখন একটু আধটু করে বলতে ও চিনতে পারছে ‘অ, আ, ক, খ’।

এরইমধ্যে তার আচার-আচরণেও এসেছে আম‍ূল পরিবর্তন। এখানে-সেখানে বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ানো বশির ঠিকই মনের রঙে রাঙিয়েছে নিজের ক্যানভাস। জানতে পেরেছে বাংলার ইতিহাস-সংস্কৃতি।

বশিরের মতো ছিন্নমূল শিশু জাবেদা, আয়েশা, বাপ্পারাজ, রুবেল ও শ্রাবন্তীর মতো স্বপ্ন পূরণের এ পথ করে দিয়েছে ‘তারুণ্য প্রজাপতি স্কুল’।
tarunna_school_01
আর উদ্যোগটি নিয়েছেন ‘তারুণ্য’ নামের স্বেচ্ছাসেবামূলক একটি সংগঠনের স্বপ্নবাজ ৮ তরুণ। তারা হলেন- আল মাকসুদুল হাসান, প্রত্যয় পাল, রুদ্র প্রকাশ দত্ত, সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান, শরীফুল আলম, উবায়দুল হক, বিপুল সরকার ও মারুফা আক্তার মৌসুমী।

সবাই স্থানীয় বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী। উদ্যমী এ তরুণরাই সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুদের মুখে ফুটিয়েছে এক চিলতে হাসি। আঁধার তাড়িয়ে রাঙিয়েছে আপন ভুবন।  

২০১৪ সালের শেষভাগে শহরের বিপিন পার্কের পেছনের বস্তিতে জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে জরিপ কার্যক্রম শুরু করে ‘তারুণ্য’।

ওই বস্তির শিশুদের করুণ মুখ তাদের নাড়া দেয়। তারা দেখলেন, বস্তির সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পড়াশুনার আগ্রহ।

এসব শিশুদের মা-বাবারাও তাদের সন্তানকে পড়াতে চান। কিন্তু এ স্বপ্ন তাদের কাছে অনেকটাই ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’র মতো। উদ্যমী তরুণরা কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করলেন। এ তাগিদ থেকেই শুরু হলো চ্যালেঞ্জ। বিপিন পার্কে এক বিকেলে চা’র কাপে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেরাই কোমলমতিদের পড়াশুনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গড়ে তুললেন ‘তারুণ্য প্রজাপতি স্কুল’। প্রথম দিকে ওই বস্তির সুবিধা বঞ্চিত ২৫ শিশুকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের চরের এখানে-সেখানে গাছতলায় কিংবা খোলা আকাশের নিচে শুরু হলো পাঠদান। বিতরণ করা হলো বাংলা বর্ণমালার বই। মাস দু’য়েক এভাবেই চলছিল।

সমমনা বন্ধুদের এ উদ্যোগে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলেন বিপিন পার্কের গার্ড শামসুদ্দিন।

তিনি জায়গা দিলেন পার্কের নিজের কক্ষে। অস্থায়ী এ পাঠশালায় সপ্তাহের চারদিন দুপুর ১২ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত চলে বর্ণমালা শেখার কসরত। কিন্তু ওই কক্ষে ফাটল আতঙ্কে বন্ধ হয়ে যায় তরুণদের এ প্রচেষ্টা।

কিন্তু থেমে থাকেননি তারা। উচ্ছ্বাসে কমতি ছিল না শিশুদেরও। তাই আবারও এই তরুণরা শিশুদের নিয়ে নিয়ম করে ফিরলেন পার্কের গাছতলায় অথবা খোলা আকাশের নিচে। বস্তির শিশুদের আলোকিত করার প্রয়াসে।

পাঠশালার ছাত্র বাপ্পারাজ ও জাবেদ‍ার ভাষ্যমতে, ‘স্যার-ম্যাডামরা আমাদের অনেক আদর করে। বিভিন্ন ছড়া পড়ে আনন্দ পায় তারা। তবে এজন্য কোনো বেতন দিতে হয় না। ’

এই দুই ছাত্র জানালো, তারা এখন অ, আ, ক, খ চিনে। বলতেও পারে। পড়তেও ভালো লাগে। শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজ-খবরও  করেন নিয়মিত।

এ পাঠশালার উদ্যোক্তা এবং শিক্ষকদের একজন আল মাকসুদুল হাসান। উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘বস্তির শিশুরা সব সময়ই বঞ্চিত। শিক্ষা, সামাজিক আচার-আচরণ কোনোটিই তাদের নেই। একটা পর্যায়ে এসব শিশু বখে যায়। তাদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে শুধুমাত্র সুশিক্ষা। ’
tarunna_school_2
‘শিক্ষার আলোয় এসব শিশুরা আলোকিত হয়ে গড়ে উঠলে আমাদের সমাজটাই বদলে যাবে। আক্ষরিক অর্থেই আমরা এ স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন করতে চাই,’ তার সঙ্গে  যোগ করেন আরেক উদ্যোক্তা প্রত্যয় পাল।

এদিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখেননি এই তরুণরা। বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডেও নিজেদের জড়িয়েছেন তারা।

আর এ স্বপ্ন বুনে দেন শরীফুল আলম নামে এক তরুণ। সময়টা ২০১১ সাল। শরীফুল তখন শহরের সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র।

সেই সময় তার ৫ বড় ভাই মাসুদ, প্রত্যয়, বিপুল, রুদ্র ও হিমেল মিলে সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার ধুরাইল গ্রামে ১৫০জন অতিদরিদ্র ব্যক্তির মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।

এরপরই পুরোদমে শুরু হয় ‘তারুণ্যে’র মিশন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরের রমজান ঈদে ১১০ জন পথশিশুর হাতে নতুন জামা তুলে দেওয়া হয়।  

ওই বছরের ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবসে ‘এক বেলা হাসিমুখ’ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তারা।

সেখানে শহরের বিভিন্ন এলাকার ৮০ জন পথশিশুকে এক বেলা উন্নতমানের খাবার দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের চিড়িয়াখানা দর্শন, পার্কে ঘোরাঘুরি, প্রতিযেগিতামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

চলতি বছরের ২০ নভেম্বরও একই কর্মসূচি পালন করা হয়। এবার শিশুদের এ আনন্দ উৎসবে শামিল হন ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু। এ সময় শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।
tarunna_school_3
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।