রাস্তার ধারে বিভিন্ন পিলারের সঙ্গেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মরদেহ।
চারুকলার শিক্ষার্থীদের তৈরি করা এসব প্রতীকী মরদেহের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি হানাদার নরপিশাচদের নারকীয় গণহত্যার চিত্র।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানিরা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’- এর নামে ওই রাতে ঢাকাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। তাদের টার্গেটে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আল্লামা ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল।
জগন্নাথ হলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অনেক মানুষকে। শহীদদের মধ্যে নাম জানা গেছে ৪ জন শিক্ষক এবং ৬৩ জন শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর।
ভয়াল সেই রাতের ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন বর্তমানে জগন্নাথ হলের গেটম্যান অবিনাশ চন্দ্র বিশ্বাস। সে সময় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। থাকতেন জগন্নাথ হলের তখনকার আবাসিক শিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ নাথের ৪৬নং আবাসিক ভবনে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার বাবা সে সময় হলের গেটম্যান ছিলেন। সে সূত্রে আমি স্যারের (গোপাল কৃষ্ণ নাথ) বাসায় আসি। ২৫ মার্চ ভবনটিতে আটকা পড়ি। আমরা সেখানে মোট ১৪ জন ছিলাম। তিনতলা ভবনের নিচতলায় দুই দেয়ালের মাঝখানে আমরা লুকিয়ে থাকি’।
সারা রাত অন্ধকারে ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বাতি জ্বালালে সঙ্গে সঙ্গে স্যার নিষেধ করে অফ করে দেন। তাদের হামলায় ভবনের গ্লাস ভেঙে যায়’।
২৬ মার্চের দিনের চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘২৬ মার্চ সারাদিন না খেয়ে ছিলাম। চারদিকে শুধু লাইন ধরে মানুষ পড়ে আছেন। পাকিস্তানি বাহিনী কতোক্ষণ পর পর ট্রাকে করে মরদেহ নিয়ে ক্যাম্পে রাখে। সন্ধ্যার দিকে মরদেহগুলোকে গণকবর দেওয়া হয়’।
‘২৭ মার্চ কারফিউ শেষ হলে বেঁচে যাওয়াদের সঙ্গে দেখা হয়, তখন তারা জানান, অনেকে পুকুরে, আবার কেউবা ভবনের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিলেন’।
নিকষ কালো ২৫ মার্চ রাতে প্রাণ হারান দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জোর্তিময় গুহঠাকুরতা, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র ভট্টাচার্যসহ অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী। মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিতে বাইরের কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থীরাও প্রাণ দিয়েছেন।
গণহত্যা দিবসে হলজুড়ে মরদেহের প্রতীকী প্রদর্শনীর মাধ্যমে শনিবার (২৫ মার্চ) স্মরণ করা হচ্ছে শহীদদের।
দুই প্রবেশ গেট, জোর্তিময় গুহঠাকুরতা ভবন, প্রাধ্যক্ষ ভবনের প্রবেশ পথ, পুকুর পাড়, রেকর্ড স্মারক ফলক, স্বামী বিবেকানন্দ ভাস্কর্য, গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবন, নবনির্মিত ফলকের চারপাশে সারি সারি মরদেহ। কারো হাত বাধা, আবার কারো গলায় রশি দিয়ে পিলারের সঙ্গে বাঁধা। অনেক জায়গায় একটি মরদেহের ওপর আর একটি মরদেহ উপুড় করে রাখা হয়েছে। কারো জামায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী মিথুনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা একাত্তরের ভয়াল রাত দেখিনি। কিন্তু প্রতীকী এ দৃশ্যের মাধ্যমে সেই রাতে পাকিস্তানিদের গণহত্যা-তাণ্ডবের কথা অনুধাবন করতে পেরেছি’।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তৈয়ব উদ্দীন বলেন, ‘শহীদদের মরদেহের দৃশ্য দেখার মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারবো’।
কালরাতে প্রাণ হারানো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণসমাধি ফলক উন্মোচন করা হয় ১৯৮১ সালের ৪ ডিসেম্বর। আর ৪ শিক্ষক ও ৬৩ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীর নাম সম্বলিত ফলক নির্মিত হয়েছে, যার উদ্বোধন করা হবে শনিবার রাতে।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘ফলক ও প্রতীকী মরদেহের দৃশ্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে পড়বে। জগন্নাথ হলে চলা সে সময়ের নারকীয় গণহত্যার কথা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবে নতুন প্রজন্ম।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
এসকেবি/এএসআর